শুরু হয়ে গেল রোজা। রোজার আগেই দেশে ফেরার কথা ছিল। ফেরা হলো না। করোনাভাইরাস এসে সব বদলে দিল। সেই ফেব্রুয়ারিতে এসেছি ছেলেদের কাছে। সিডনিতে দুই ছেলে একসঙ্গেই থাকে। বড় ছেলে বিয়ে করেছে, ওর সন্তান তিন বছরের। আমরা দাদা-দাদী এসেছি মূলত ওর সান্নিধ্যেই কাটানোর জন্যে। প্রায় দুমাস এখানে থেকে দেশে ফিরে আবার কাজে আত্মনিয়োগের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মহান আল্লার দরবারে আমাদের পরিকল্পনা কবুল হয়নি। এখানে আসার কিছুদিন পরই অল্প অল্প করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের খবর পাচ্ছিলাম। কিন্তু অল্পদিনের ভেতরেই যে তা এমন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়াবে আর জীবনযাপনের ধরনটাই বদলে দেবে-- আমরা ক’জনই বা এ বিষয়ে আগাম ধারণা করেছি! আন্তর্জাতিক ফ্লাইট একে একে বন্ধ হয়ে গেল। আমরাও নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে রোজার আগেই আমাদের আর দেশে ফেরা সম্ভব হবে না।
আমার স্ত্রী রান্না করে খাওয়াতে পছন্দ করেন। আর এখন তো দুই সন্তান, আর বৌমা ও নাতনিকে রেঁধে খাওয়ানোর দারুণ সুযোগ পেয়ে তা কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নন। পারিবারিক সম্মিলনের অন্যরকম একটা আনন্দ রয়েছে। সবাই মিলে এক টেবিলে খাওয়া, গল্প গুজব, টিভি দেখা এবং করোনা নিয়ে আলোচনা করা, সব মিলিয়ে দিনগুলো মন্দ কাটছে না। একটা রুটিনের ভেতর অভ্যাসমাফিক দিনযাপন। এখানে বিশেষ অভিজ্ঞতায় দেখা হলো একটি উন্নত দেশ কিভাবে মহামারীর মোকাবেলা করে এবং সুপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে দুঃসময়কে অতিক্রম করতে পারে। নাগরিকদের প্রচেষ্টায় অল্প ক্ষতির মধ্য দিয়ে দেশকে বিরাট বিপদ থেকে মুক্তির পথে যাওয়া কম সফলতার বিষয় নয়। আমি তো বলবো এর নেপথ্যে রয়েছে সরকারের সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নাগরিকদের শতভাগ সহযোগিতা। সিডনিতে না থাকলে এমনভাবে বিষয়টি হয়তো উপলব্ধি করতে পারতাম না।
এখানে আমার প্রতিদিনের রুটিন যেভাবে শুরু হয়েছিল সেটা বলি। সকাল আটটায় বৌমা আর নাতিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। নাতিকে ডে কেয়ার সেন্টার আর বৌমাকে তার অফিসে ড্রপ করে চলে আসতাম ঘরে। বৌমা একজন প্রকৌশলী হলেও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট কোম্পানিতে চাকরির কারণে লকডাউনের ভেতরেও অফিসে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। বিকেলে নাতি আর বৌমাকে যারযার জায়গা থেকে তুলে বাসায় ফিরে ফের বেরিয়ে পড়তাম নাতিকে নিয়ে সুইমিংপুলে সাঁতার শেখাতে। দিনের এই পর্বটি ছোট্ট শিশুটির কাছে ভারি উপভোগ্য এক কাজ। কী চমৎকারই না কাটছিল আমার ছুটি। মাঝে স্ত্রীর এক বান্ধবীর মেলবোর্নের বাড়ীতেও গিয়েছিলাম দু’জনে বেড়াতে। সুন্দর অবকাশ যাপনের ভেতর এসে বাদ সাধলো করোনাভাইরাস। অস্ট্রেলীয় সরকারের পক্ষ থেকে একের পর এক ঘোষণা আসতে শুরু হলো। সামাজিক মেলামেশার নিষেধাজ্ঞা এলো সবকিছুর আগে। ফলে বন্ধ হয়ে গেল সুইমিং সেন্টার। নাতির সঙ্গে দিনের মধুরতম পর্বটিই স্থগিত হয়ে গেল। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনাগুলো বেশ কঠোরই ছিল। সামাজিক, মানে পারস্পরিক শারীরিক দূরত্ব তো বজায় রাখতেই হবে বাইরে বেরুলে, তারওপর দুজনের বেশি এক পরিবার থেকে বাইরে বের হলে এক হাজার ডলার তাৎক্ষণিক জরিমানা, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরুনোর নিষেধাজ্ঞা, ইত্যাদি। অবাক হতে হয় এখানকার মানুষের সচেতনতাবোধ দেখে। সরকারঘোষিত প্রতিটি নির্দেশনা এদেশের মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে বলেই এত তাড়াতাড়ি কোভিড-১৯ রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। এখন পর্যন্ত গোটা অস্ট্রেলিয়ায় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মাত্র পৌনে সাত হাজারের মতো। মৃত্যুর সংখ্যা মোটে ৭৮ জন। দুকোটি ৫৬ লাখ অধিবাসীর এই উন্নত দেশটি চাহিদার তুলনায় তিনগুণ বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করে। তারপরও করোনার প্রাদুর্ভাবকালে নাগরিকদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক দেখেছি, তারা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জিনিস কিনতে শুরু করে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোনো কোনো পণ্যের সাময়িক স্বল্পতা দেখা দেয় শপগুলোয়।
একটা শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতার কথা বলি। একদিন আমরা পরিবারের কয়েকজন মিলে সাধারণ কেনাকাটা করে ঘরে ফিরছিলাম। রাস্তায় টহল পুলিশ আমাদের দাঁড় করান। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে এবং সবাই সিটবেল্ট বাঁধা অবস্থায় থাকায় পুলিশ সন্তুষ্ট হন। বৌমা তার পুত্রকে মজা করার জন্য বলে যে, তার কথা না শুনলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সদস্য আপত্তি জানান এবং বলেন যে শিশুদের পুলিশ সম্পর্কে খারাপ ধারণা দেয়া উচিৎ নয়। পুলিশ হলো শিশুদের বন্ধু। যাহোক, সেদিন কোনো জরিমানা গুনতে হয়নি। আমরা শিশুসহ কেন চারজন বাইরে বেরিয়েছি তার যৌক্তিক কারণ দেখাতে হয়েছিল পুলিশকে। আরেকদিন সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম কস্টকো (বড় গ্রোসারি শপ) থেকে প্রয়োজনীয় দুয়েকটা জিনিস কিনতে। গিয়ে দেখি কয়েক শ’ লোক ট্রলি হাতে সুশৃঙ্খলভাবে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কোনো উচ্চবাচ্য নেই, সবার যেন অসীম ধৈর্য্য। আমার অবশ্য অত ধৈর্য্য নেই, লম্বা লাইন দেখে সোজা চলে এসেছিলাম ঘরে।
ছোট্ট একটি ঘটনার উল্লেখ করে লেখার ইতি টানছি। এলিমেন্টস বার অ্যান্ড গ্রীল নামে আমার বড় ছেলের একটি রেস্টুরেন্ট আছে এখানে। প্রথম ধাপেই সরকার দেশের সব রেস্টুরেন্ট বন্ধের নির্দেশ দেয়। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মন একটু খারাপ। কিন্তু সাতদিন না যেতেই বিদেশ থেকে আসা বাধ্যতামূলকভাবে একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকা নাগরিকদের তিনবেলা খাবার সরবরাহের একটি কন্ট্রাক্ট পায়। ফলে আবার বড় ছেলের উপার্জন চালু হয়ে যায়। আমরাও স্বস্তি বোধ করি। আমাদের হোম কোয়ারেন্টিনের দিনগুলো আবার আনন্দপূর্ণ হয়ে ওঠে।
লেখক: বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড) এর মহাপরিচালক