করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০১ সংখ্যা
আগস্ট ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





নূরেমবার্গে গৃহবন্দী জীবন
হাসান ইফতেখার
ডিসেম্বরে যখন করোনার আভাস পেলাম তখন এর প্রভাব সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। কারোরই না। ক্রিসমাসের ছুটিতে গাড়িতে করে রওয়ানা দিলাম ফ্রাঙ্কফুর্ট। আমাদের বাসা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে। স্ত্রী ও ছোট দুই ছেলে সাথে। মনের ভেতর কিছুটা উসখুশ। কী হবে ! ফ্রাঙ্কফুর্টে দুই রাত কাটিয়ে গেলাম আরো ২৫০ কিলোমিটার দূরে কোলনের কাছে। তিনদিন ওখানে থাকলাম। ভাবছিলাম আর এগানো ঠিক হবে কিনা। এবার আমাদের গন্তব্য উটরে, আমস্টারডামের কাছে। আরো আড়াইশ’ কিলোমিটার পথ। বড় ছেলে ওখানে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সঙ্গে গবেষণার কাজে নিয়োজিত। গবেষণার বিষয় : সংক্রমণ ব্যাধির দ্রæত প্রসার রোধ। সেখানে বেশি সময় নিলাম না। রাতটা কাটিয়ে পরদিনই পুত্রকে নিয়ে ফিরলাম ঘরে, ন্যূরেমবার্গে। এবার একটানা ফেরা, কোথাও থামাথামি নেই। জানুয়ারির শেষে খবরে শুনি চীনে করোনার প্রভাব দিনদিনই বাড়ছে। ওই সময়টাতেই আমাদের প্রদেশের ছোট্ট এক শহর, গ্রাম বলাই ভালো, সেখানে করোনা ধরা পড়েছে। জার্মানিতে প্রথম কোভিড-১৯ রোগীর অস্তিত্ব ! আমাদের এ প্রদেশের নাম বায়রন, ইংরেজিতে বেভারিয়া। এই প্রদেশের এক কারখানায় চীনদেশ থেকে এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন ট্রেনিংয়ে। তার কাছ থেকেই করোনা প্রথম সংক্রমিত হলো। সেই মহিলার সংস্পর্শে কারা কারা এসেছেন তার খোঁজখবর শেষে তাদের প্রত্যেককেই কোয়ারেন্টিনে রাখা হলো। একইসঙ্গে তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়াও শুরু হলো। শুধু চীন থেকে আসা নাগরিকবৃন্দ, কিংবা সেখানে বেড়াতে গিয়ে ফিরে এসেছেন, এমন লোকের মধ্যেই নয়, করোনা ধরা পড়লো তাদের ভেতরেও যারা ইটালি ও অস্ট্রেলিয়ায় জার্মানি থেকে শীতের ছুটিতে গিয়েছিল স্কি করতে। আমাদের শহরেও শুরু হলো অনেককে কোয়ারেন্টিনে রেখে চিকিৎসা দেয়া। যারা ওইসব লোকের সংস্পর্শে এসেছে তাদের শনাক্ত করা হলো।
ওই সময়টাতেই যেন কেনাকাটার হিড়িক পড়ে গেল। কিছু কিছু পণ্যের স্টক শেষও হয়ে গেল, যদিও পরবর্তীকালে সেসব আবার পাওয়া গেল সরবরাহ স্বাভাবিক হলে। সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিলো টয়লেট পেপারের। জার্মানরা প্রচুর পরিমাণে টয়লেট পেপার স্টক করতে শুরু করলো। এদেশের মানুষের পানি ব্যবহার করে শৌচকর্ম সম্পাদনের সংস্কৃতি নেই। এ ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ। তাদের ভেতর এই চিন্তাই বেশি বেশি কাজ করলো যে যদি দীর্ঘদিন গৃহবন্দী থাকতে হয় তাহলে প্রাকৃতিক কাজ শেষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে কী উপায়ে ! তাই দুয়েক মাসের টয়লেট পেপার একসাথে কিনে ফেলতে শুরু করলো তারা। হঠাৎ করে একটি পণ্যের চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলে যা হয় সেটাই হলো। টয়লেটপেপারশূন্য হয়ে পড়লো দোকানগুলো। অবশ্য পরে আবার সরবরাহ এলো। জার্মানদের যুদ্ধবিগ্রহের অভিজ্ঞতা তো কম নয়। তারা ভালোই জানে নিজের ঘরের ভেতর কী কী তালাবন্দি করে রাখতে হবে। সত্যি বলতে কি, এসব আমাদের কাছে অনেক সময় বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়।
যাহোক, চারদিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগলো। করোনার বিস্তার কিভাবে কমানো যায়, পুরোপুরি ভাইরাসটিকে কি উপায়ে দমন করা সম্ভব-- এইসব নিয়ে জল্পনাকল্পনা, আলাপ-আলোচনা সবখানে। এভাবেই কেটে গেল ফেব্রæয়ারি মাস। আমার অফিস জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এদেশের পরিস্থিতি সার্বিক বিবেচনা করে মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করলো হোম-অফিসের নিয়ম। ব্যস আমার গৃহবন্দী জীবনও শুরু হলো।
এদেশের নিয়ম অনুযায়ী একসঙ্গে দুইজনের বেশি বাইরে যাওয়া যাবে না। এক পরিবারের হলে দুজনের বেশি বাইরে যাওয়া যাবে। তবে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তাও শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনেই বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে। একজনের সঙ্গে অপরজন দেড়-দুই মিটার দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। বাড়ির কাছাকাছি হাঁটাচলা করার অবশ্য সুযোগ ছিল। আমাদের ভাষায় হাওয়া খেতে যাওয়া। সেই মার্চ থেকেই গৃহবন্দী জীবন। সপ্তাহে দুয়েকদিন বাজারে যাই। বাসার কাছেই ছোট্ট নদী পেগনিট্স, সেই নদীর ধারে যাই পরিবারের সবাই মিলে। বেড়িয়ে আসি। এছাড়া সারাক্ষণই ঘরে থাকা। জানালা দিয়ে দেখি ট্রাম আর বাসের যাওয়া আসা। অন্য সময় ৫-৭ মিনিট পরপর ট্রাম-বাস যেতো। এখন কুড়ি মিনিট পরপর যাওয়া-আসা। প্রায় সবগুলোই যাত্রীশূন্য। কখনো কখনো দু-তিনজন মানুষ দেখি বসে আছে যানবাহনে। তার মানে কিছু কিছু যাতায়াত চলছে মানুষের। রাস্তায়ও মানুষজন দেখা যায়। যদিও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ সচেতন থাকছে যাতে এই করোনাকালে নির্ধারিত দূরত্বটুকু বজায় থাকে। যেদির রোদঝলমল থাকে দিনের অনেকটা সময়, সেদিন লোকে বেশি সংখ্যায় ঘরের বাইরে যায়। তা দরকারেই হোক, কিংবা শুধু বেড়ানোর জন্যেই হোক। সরকারি ছুটির দিন রোববারে দোকানপাট সব বন্ধ থাকে। সেদিন বহু মানুষ নিশ্চয়ই হাওয়া খেতেই বের হয়। ঢাকা শহরের চাইতে আয়তনে কিছুটা ছোট বলা যায় আমাদের শহর। সেই অনুপাতে জনসংখ্যা কমই, মাত্র পাঁচ লাখ। আর বাঙালি পরিবার হবে পঞ্চাশ থেকে ষাট। এখন পর্যন্ত আমরা বাঙালিরা এখানে করোনামুক্ত রয়েছি।
পরিবারের সবাই মিলে গল্পগুজব, রান্না বান্না, খেলাধুলা, এটা সেটা করা-- এভাবে সময় অবশ্য কেটেই যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে অধৈর্য্য হয়ে উঠি। নিজে নিজেই ভাবি, এদেশের অনেক মানুষ যারা একদম একা একাই থাকে বিরাট বাড়িতে। কোনো সঙ্গী নেই। তারা কিভাবে জীবনযাপন করে ! ওদের কথা চিন্তা করলে তো বলতেই পারি, ভালোই আছি এই গৃহবন্দিত্বের কালে।
১৯ এপ্রিল ২০২০/ জার্মানি থেকে