করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





পঞ্চাশের পরের পথ
ওমর শামস
রবীন্দ্রনাথ প্রায় একাই বাংলায় রোমান্টিসিজম পিরিয়ডের কবিতার জনক। ছন্দর  একটা বড়ো অংশের জনয়িতা তিনি, তেমনি গীতি-কবিতার পূর্ণপ্রকাশ তাঁর কলমেই।  তাঁর পরে তিরিশের কবিরা, যাঁরা আধার ও আধেয় উভয় ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ থেকে পৃথক। দুর্গম পাহাড়ের ওপারের শক্তিকে এঁরা ডাকেন নি, কোনো নিপুণ আদর্শিকতাও এঁদের কবিতার সারবত্তা নয়। সমাজ-ও-ইতিহাস-চেতনার রাবীন্দ্রিক সীমানা পেরোনোর পরে ব্যক্তি-আত্ম-কাল-সচেতন  দৃষ্টিকোণ থেকেই তিরিশের কবিদের রবীন্দ্রোত্তর অথবা আধুনিক কবিতা। কালিক-বৈশ্বিক পটভূমিতে ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র-সমাজের সংকট নিয়েই এঁরা লিপ্ত ছিলেন। পঞ্চাশ এবং তার পরের বাংলাদেশের কবিতা তিরিশের কবিদের কবিতার বিস্ত্রৃতায়ন – বোধ এবং আঙ্গিক, দু-দিক থেকেই।
আবার বলা যেতে পারে :   (১) রবীন্দ্রনাথ-এর  কাল  বাংলা কবিতার রোমান্টিসিজমের কাল, (২) তিরিশের কবিদের কাল আধুনিক বাংলা কবিতার কাল, (৩) পঞ্চাশের পরের কবিতা তিরিশের কবিতার বিস্তৃতির ক্ষেত্র।   
উল্লেখ করতে হবে, বাংলার আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা জীবনানন্দ দাশ (আধুনিক    কবিতা, কবিতার কথা) ছাড়া কারুর কাছে আমি সঙ্গতিশীল, ইতিহাসের সঙ্গে পারম্পর্যশীল এবং যুক্তিসম্পন্নভাবে পাই নি। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (কাব্যের মুক্তি, স্বাগত ) এবং বুদ্ধদেব বসু-র (বোদলেয়ারের কবিতা এবং মেঘদূত-এর ভূমিকা) গদ্যে তার কিছু চিহ্ন নির্দেশিত আছে। হুমায়ুন আজাদ (আধুনিক বাংলা কবিতা-র ভূমিকা) জীবনানন্দ দাশ-এর সংজ্ঞার খুঁত ধরেছেন, কিন্তু তাঁর ধারণায় আকারইঙ্গিত আছে সম্যক স্পষ্টতা নেই। সতেরো শতক থেকে বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি এবং ফলিত প্রয়োগ থেকে থিয়োরি অব নলেজের থেকে যে ধাক্কা এসে লাগলো ভিন্ন শিল্প মাধ্যমে এবং মানুষী সমাজে যে পরিবর্তন ঘটলো, তার থেকেই জন্ম নিয়েছিলো “আধুনিকতা”-র  ধারণা।   বোদলেয়ার-এর কবিতার চিন্তা এবং বিশ শতকের আভা গার্ড (সুররিয়ালিজম, দাদাইজম,   এক্সিসটেন্সিয়ালিজম ইত্যাদি ) এই ঐতিহাসিক ধারার-ই অন্তর্গত।  মানুষের বিজ্ঞান-চিন্তা, উৎপাদন ব্যবস্থা, জীবনযাত্রা সমূহ পাল্টালো বলেই কবিতাও পাল্টালো আধেয়-আধার উভয় ক্ষেত্রে।   
সন্নিহিত আরেকটি প্রসঙ্গ : কেউ-কেউ মনে করেন আধুনিকতার চিন্তা ইউরোপ থেকে ধার করা, অতএব তার মর্যাদা ও গুরুত্ব কম, শুধু আমদের দৈশিক সংস্কৃতির থেকেই শিল্প উদ্ভাবন করা উচিত। আমাদের নিজস্ব কীর্তির গুরুত্ব অবশ্যম্ভাবী। কবিতা জীবনের থেকে উৎসারিত, অতএব বাংলা বদ্বীপের নদী-জলা-জংলা-ধান-পাখি-চিড়ে-কুড়ো-লুঙ্গি-শাড়ি-শিশু-তরুণ-তরুণী-গঞ্জ-নগর-সকাল-বিকাল যে কবিতায় এসেছে এবং আসবে, সেটা তর্কের ব্যাপার নয়।  তবে কবিতাও একটি জ্ঞান এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে সকল মানুষী গোত্রের মধ্যে আদান-প্রদান রয়েছে। ফরাসী প্রভেঙ্কাল কবিতা আরবী কবিতা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলো, আরবী এবং ফার্সি কবিতার মধ্যে আদান-প্রদান হয়েছে, ইতালীয় সনেট ফর্ম সর্ব ভাষায় লেখা হয়েছে বিশ শতকী ইংরেজি কবিতা উনিশ শতকী ফরাসী কবিতা দিয়ে প্রভাবিত, বিশ শতকী স্পানীশ কবিতা ইংরেজী এবং ফরাসী কবিতা দিয়ে প্রভাবিত, আজকাল আমেরিকান কবিরাও গয্ল লেখে - উদাহরণ আরো লম্বা করা যেতে পারে। জরুরী  কথা হচ্ছে, অনুসরণ নয় বোধ এবং জ্ঞানকে পরিপাক করে নিজস্ব করে নেয়া নিজের ঐতিহ্যর সঙ্গতিতে। বিশ শতকের বাংলা কবিতায় এই ঘটনার সফল সাক্ষ্য আছে। সঙ্গে-সঙ্গে দেশজ প্রাচীন উপাদানের চমৎকার পুনঃপ্রকাশও হয়েছে। “বেহুলাও একদিন ...ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিলো ইন্দ্রের সভায় বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়”, এই এক লাইনেই জীবনানন্দ মনসামঙ্গল-এর শৈল্পিক নির্যাসটুকু নিংড়ে নিয়েছলেন একটি সনেটের জন্য।
বোধ এবং আঙ্গিকের বিচারে,  পঞ্চাশ এবং তার পরের বাংলাদেশের কবিতা  তিরিশের কবিদের কবিতার ক্রমগতি। তবে, কালপ্রবাহের  সঙ্গে  ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-সংগ্রাম পঞ্চাশোত্তর  বাংলাদেশী কবিতার একটি প্রধান বিষয়। উত্তরাধিকার সূত্রে এই সময়ের কবিরা প্রেমকেও অবহেলা করতে পারেন নি। ফলে, মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা  এবং প্রেম- এ-দুটোই কবিতার প্রধান বিষয়।  এর বাইরের বিষয়ও আছে, তবে সেগুলো কি খুব মুখ্য হয়ে উঠেছে ?  পঞ্চাশের পরের কবিতায় বাংলাদেশের একটি কাল, তার সংগ্রাম, জয়, অতঃপর অস্থিরতা, সংশয়, ভালোবাসা, বাঙালির টিকে থাকা মর্মরিত হয়ে উঠেছে। তবু আধেয়কে সংকীর্ণ মনে হয় আমার। কবিতা টুথব্রাশ নিয়েও হতে পারে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট নিয়েও হতে পারে – প্রেম নিয়ে তো বটেই। বিশ শতকের এবং একুশ শতকের শুরুর স্থানিক-কালিক ঘটনা বিশাল। প্রথম মহাযুদ্ধ, ১৯১৪-১৯১৮ // রুশ বিপ্লব, ১৯১৭ // বিশ্বমন্দা-অর্থনৈতিক ধস // রিলেটিভিটি-জেনেরাল রিলেটিভিটি-কোয়ান্টাম বিদ্যা //  দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ১৯৩৯-১৯৪৫ // হিরোশিমা নাগাসাকিতে আণবিক বিস্ফোরণ // রুশ-আমেরকার ঠাণ্ডাযুদ্ধ, ১৯৪৫-১৯৯১ // ডি-এন-এ আবিষ্কার, ১৯৫৩ // ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ১৯৫৫-১৯৭৫ // ইসরায়েল-আরব সংঘর্ষ-বিরোধ // জাপান জার্মানি ব্রিক উত্থান // সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙ্গন, ১৯৯১ // আফগানিস্তান ইরাক লিবিয়া আক্রমণ // ২০০৮ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট // সিরিয়া সংকট । ব্যক্তিগত উক্তি ও উপলব্ধির বাইরে, এতোসব ঘটনার কিছু প্রকাশ কবিতায় কি প্রত্যাশিত নয়?  
আমরা চাই, বাংলাদেশের কবিতা আরো সমৃদ্ধ হোক । অর্থে, টেকনোলজিতে টেক্কা দেয়া দুরূহ, কিন্তু মানবিক মননে আমরা ফ্রন্টিয়ারে থাকতে পারি।