করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





যুদ্ধ
ইসহাক খান
আমরা যাচ্ছি বাজিতপুর। আমাদের গ্রাম থেকে বাজিতপুর তিন মাইল দক্ষিণে। সেখানে একজন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা থাকেন। যুদ্ধে তিনি দু’পা হারিয়েছেন। মর্টারের সেল লাগায় দুটি পা-ই কেটে ফেলতে হয়েছে। হুইল চেয়ারই তার একমাত্র অবলম্বন। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি আহত, নিঃসঙ্গ। তার মনের জোর পাহাড় সম। তার সম্পর্কে এত কিছু শোনার পর তাকে স্বচোখে দেখবে দাউদ। তার কাছে যুদ্ধের গল্প শুনবে।
দাউদ কখনও মুক্তিযোদ্ধা দেখেনি। তারা কি আমাদের মতোই মানুষ? তারা কিভাবে জীবন-যাপন করে-এসবই জানতে চায় দাউদ। দাউদের এই ধরনের আবেগী কৌতূহল ইদানীং বড় বেশি আমাকে টানা-হেচড়া শুরু করেছে। আগে ছিল না। উল্টো মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক ধরনের কথাবার্তা বলতো। বলতো, ভারত ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান নামক মুসলিম রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে কৌশলে রাষ্ট্রটি ভেঙ্গে দু’টুকরো করেছে। এ সব তথ্য সে তার পারিবারিক আবহে পেয়েছে। যে কারণে ভারত দেশটি তার কাছে ভীষণ ঘৃণ্য।
একটি খালের পাড়ে এসে আমাদের যাত্রা থেমে গেল। খালটা মোটামুটি প্রশ্বস্ত-গভীরও। পারাপারের জন্য খালের উপর বাঁশের একটি সাঁকো। আড়াআড়ি ভাবে বাঁশ পুঁতে তারউপর একটি বাঁশ লম্বা ভাবে ফেলে রাখা। ধরার জন্য একটি বাঁশ বাঁধা। আমি অনায়াসে সাঁেকা পার হলেও দাউদ থমকে যায়। আমার মতো ও অভ্যস্ত নয়। ও হাতলের বাঁশ ধরে খানিক আসার পর ওর হাত-পা কাঁপতে থাকে। আমি যত ওকে সাহস যোগাই ও ততো ভয়ে পিছিয়ে যায়।
খালের এপারে আমি ওপারে আমার চাচাতো ভাই দাউদ। আমার বড়চাচার মেঝছেলে। বড়চাচা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর দোসর ছিলেন। শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। কথিত আছে-অনেক হিন্দু বাড়িতে তার বাহিনী লুটপাট করেছে। আরো অনেক জঘন্য কাজের সে হোতা। স্বাধীনতার পরে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। দাউদের জন্ম সেখানেই। এই প্রথম ও বাংলাদেশে এসেছে। আমরা দু’জন সমবয়সী। ত্রিরিশ ছুঁই ছুঁই আমাদের বয়স। দু’জনেরই লেখাপড়ার পাঠ শেষ। দাউদ বাংলা ভাল বলতে পারে না। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে যা বলে শুনে আমার ভীষণ মজা লাগে। আমি ওর ভাষার নাম দিয়েছি বাংলিশ।
বাংলিশ শব্দটা দাউদের ভীষণ পছন্দ। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার ধারনা পাল্টে যাবার পর এখন সব কিছুতে ওর অপার কৌতূহল-এর মানে কি? এটা কেন হয়? এর পর কি হবে? আমি কখনও মজা করে ওর প্রশ্নের জবাব দেই। আবার কখনও সিরিয়াস। আমি যা বলি দাউদ তাই বিশ্বাস করে। কিন্তু কখনও আমার ঠোঁটের আড়ালে মুচকি হাসি দেখে ওর অন্যরকম কৌতূহল হয়। আমাকে চেপে ধরে-‘তুই হাসলি কেন? এই হাসির অর্থ কি?’ হাসির অর্থ না জানা পর্যন্ত দাউদের প্রশ্ন শেষ হয় না।
দেশে আসার পর ওর সার্বক্ষণিক সঙ্গি আমি। আমি চোখের আড়াল হলেই দাউদ অস্থির হয়ে পড়ে। আমাকে ছাড়া ওর একদন্ড চলে না। আমাকে নাকি ভীষণ ভাললেগেছে ওর। আমার ভেতর নাকি অন্য একজনের সন্ধান পেয়েছে দাউদ। ও বলে, ‘আমি নাকি ওর চোখ খুলে দিয়েছি।’
দাউদকে আমি মজা করে ডাকি ডেভিড। আমাদের একজন পয়গম্বর ছিলেন তাঁর নাম দাউদ [আঃ]। রোমান উচ্চারণে তাকে বলে ডেভিড। শিল্পী মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ডেভিডের শিশু বয়সের একটি উদোম ছবি এঁেক জগৎবিখ্যাত হয়ে আছেন। দাউদ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সে ছবি দেখেছে। দাউদের মুখেই আমি সে ছবির বর্ণনা শুনেছি। কিন্তু ও জানতো না সেই ডেভিডই আমাদের নবী দাউদ [আঃ]। আমি মজা করে ডেভিড বললে ও রাগ করে না। বরং হেসে আমার সঙ্গে তাল দেয়।  
বার কয়েক চেষ্টার পরও দাউদ সাঁকো পার হতে ব্যর্থ হংয়। আমি আবার ওর কাছে ফিরে যাই। দাউদ এমন সাঁকো দেখে মহা ক্ষিপ্ত। বলে, ‘এই অদ্ভূত জিনিসের নাম কি?’
আমি হেসে বলি, ‘এর নাম ব্রিজ। বাংলার ব্রিজ।’
‘ব্রিজ!’ দাউদ যেন আজব কথা শুনেছে। ও হাসতে-হাসতে বসে পড়ে। ‘কোন্ ইঞ্জিনিয়ার এই ব্রিজ বানিয়েছে?
তাকে ধরে এনে বিচার করা উচিত।’ আমি মনে মনে হাসি। এই বাঁশের সাঁকো বানানোর জন্যে কোন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের
প্রয়োজন হয় না। গ্রামের সাধারণ মানুষই এর ইঞ্জিনিয়ার। সবাই এটা তৈরী করতে পারে।
দাউদ বলে, ‘এখানে একটা পাকা ব্রিজ হওয়া ভীষণ জরুরী। মানুষের কত সমস্যা। কি করে তোদের পলিটিশিয়ানরা?’
আমি ইশারায় দূরে একটি ধ্বংস হওয়া ব্রিজ দেখিয়ে বললাম, ‘পাকা ব্রিজ ছিল। ক’দিন আগে একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারে ফাঁসীর রায় হওয়ার পর হরতালকারীরা রাস্তা বন্ধ করার জন্য ব্রিজটা ভেঙ্গে ফেলেছে। অগত্যা গ্রামের মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে বাঁশ দিয়ে এই সাঁকো তৈরী করেছে।’ দাউদ আমার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে। ‘মিসক্রিয়েন্টরা ব্রিজ ধ্বংস করলো আর তোরা কেউ কিছু বললি না? দেশের আইন কি করে? তাদের ধরে ফাঁসিতে ঝোলায় না কেন?’   
আমি বললাম, ‘তুইতো একদিন আমাকে বলেছিলি, ‘সরকার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিরাপরাধ ইসলাম পন্থিদের রাজনৈতিক কারণে ফাঁসী দিচ্ছে। বলিসনি?’
‘তখনতো আমি এত কিছু জানতাম না। বাসায় আব্বা-আম্মা সারাদিনই এই সব কথা বলে। আমি নিজেও ফেসবুকে এই সব দেখেছি।’
‘এখনও কি তাই মনে হয়?’ আমার এই প্রশ্নে দাউদ যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। বললাম, ‘কিছু বলছিস না যে?’ দাউদের বেদনার্ত কন্ঠ ভেসে আসে, ‘কি বলবো? মনে হচ্ছে দেশে না আসাটাই ভাল ছিল।’
‘কেন? এ কথা বলছিস কেন?’ আমি তীক্ষèভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।
দাউদ উদাস কন্ঠে বলে, ‘দেশে না এলে বাবার কদর্য অতীত জানা হতো না। এতো কষ্টও পেতাম না।’ দাউদের কন্ঠ এবার সত্যি-সত্যি বাস্পরুদ্ধ হলো। কান্না গলায় বললো, ‘বিশ্বাস কর নয়ন, আমার বাপ রাজাকার ছিল এই ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে-এই দেশটা আমার নয়। এই দেশের জন্য আমার পরিবারের কোন অবদান নেই। যখনই ভাবি-আমি একজন স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারের সন্তান-তখন সব কিছু আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে।’ দাউদ কথা শেষ করতে পারলো না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। এবং ওর সেই কান্না আমাকেও আক্রান্ত করলো। দাউদের কষ্টের চেয়ে আমার কষ্ট কম নয়। আমার বাবা সরাসরি রাজাকার ছিলেন না। কিন্তু সেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। ভাইকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা এসে বড়চাচাকে খুঁজে না পেয়ে আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। আমার বাবা ছিলেন স্কুল মাষ্টার। একজন মুক্তিযোদ্ধা বাবার ছাত্র ছিল। সেই মুক্তিযোদ্ধার করুণায় বাবা ছাড়া পায়। কিন্তু বাবা কোনদিন সেই মুক্তিযোদ্ধার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেননি। উল্টো তাকেও জালেম বলে গালাগাল দিয়েছেন। বলেছেন, ‘ওই জালেমরাই সোনার পাকিস্তান ভেঙ্গে দুই টুকরা করেছে। ওদের মাথায় ঠাটা পড়বে।’
ছাড়া পেয়ে বাবাও আত্মগোপনে চলে যান। শশুর বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে থাকেন। পচাত্তুরের পর কাছিমের মতো গর্ত থেকে মাথা বের করে বাড়ি ফেরেন বাবা। তারপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করলে মহানন্দে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে জিন্দাবাদে নেমে পড়েন।
আমাদের বাড়িটা রাজাকারের আখড়ায় পরিনত হয়। বাবা মুখে বলেন তিনি বিএনপি করেন-কিন্তু তিনি ভোট দেন দাড়িপাল্লায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তাকে প্রায়শঃ ক্ষুব্ধ হতে দেখি। রাগ ঝেরে বলেন, ‘বিয়াল্লিশ বছর পর আবার কিসের বিচার?’ আমি একদিন বলেছিলাম, ‘যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার হচ্ছে। তাতে আপনার সমস্যা কি?’ তিনি বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন। গালাগাল ঝেরে বলেন, ‘গুষ্ঠিমারি ওই বিচারের। মৌলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো আলেমকে বিচারের নামে ষড়যন্ত্র করে জেল খাটাচ্ছে। এর পরিনাম নেই?’  
বললাম, ‘বিচারকরা বলেছেন, তারা মৌলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিচার করছেন না। তারা একাত্তুর সালের দেলু রাজাকারের বিচার করছেন।’
বাবা অশ্লীল ভাষায় তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বললেন, ‘ওই কুত্তারবাচ্চাদের দলে তুইও ভিড়া গেছস!’
বললাম, ‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছো বাবা? আমি কোন দলে ভিড়ি নাই। আমি নিরপেক্ষ।’
বাবা একা একা খিস্তি করতে থাকলেন, ‘মৌলানা সাঈদী একজন বুজুর্গব্যক্তি। তার নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে বিচারের নামে ফাজলামি করা হচ্ছে। এখন তার কিসের বিচার? দাড়ি-টুপি থাকলে তার বিচার করতে হবে? সব ব্যাটা নাস্তিক। এদের কোমর পর্যন্ত মাটির নিচে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে খতম করা উচিত।’
আমি দাউদকে বললাম, ‘চল, আজ ফিরে যাই। কাল আবার আসবো। যেভাবেই হোক আমি একটা নৌকার ব্যবস্থা করবো। তোকে কষ্ট করে সাঁকো পার হতে হবে না।’
পরদিন আমরা বাজিতপুর সহজে পৌছে গেলাম। প্রথম চেষ্টাতেই দাউদ আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁকো পার হলো। আমি কিছুটা অবাক। এত সাহস ও কোথায় পেল? রাতারাতি কি এমন শক্তি ওর মধ্যে ভর করলো যে ও ছুটন্তহরিণের মতো লাফিয়ে সাঁকো পার হলো? সেই প্রশ্ন করতে দাউদ বলে, ‘একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে যাচ্ছি। আমাদেরও সাহসী না হলে চলবে?’
বাড়ি চিনতে সমস্যা হলো না। সবাই তাকে চেনে। মুক্তিযোদ্ধা বাহরাম বিশ্বাসের নাম বলতেই একজন গ্রামবাসী বললো, ‘ওই যে বাহরাম বাদশার বাড়ি।’
বাহরাম বিশ্বাসকে ওই লোকজন বাহরাম ‘বাদশা’ বললো কেন-কথাটা আমাদের দু’জনকেই কৌতূহলী করে। দাউদ আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘উনি বাদশা বললেন কেন?’
বললাম, ‘হয়তো ভালবেসে বলেছে। আসলে তিনিতো বাদশাই। দেশকে শক্রমুক্ত করতে যারা বীরের মতো যুদ্ধ করে তারাইতো প্রকৃত বাদশা।’
সাধারণ একটি বাড়ি। একচালা দু’টো ঘর আছে টিনের। বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে বাহরাম বাদশা কি যেন ভাবছিলেন। আমাদের দেখে বিস্ময়ে তাকালেন। আমরা কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে আমাদের দিকে প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে চেয়ে রইলেন। মাথায় থবথবে সাদা বাবড়ি চুল। মুখে একরাশ সাদা দাড়ি। পেটা শরীর। যৌবনে সুপুরুষ ছিলেন বোঝা যায়।
বললাম, ‘আমরা পাশের গ্রাম রোহনপুর থেকে এসেছি। আমার নাম নয়ন। ওর নাম দাউদ। ও আমার চাচাতো ভাই। লন্ডনে থাকে। আপনার সাথে পরিচিত হতে এসেছে।’
উনি হাসলেন। বললেন, ‘আমার সঙ্গে কি পরিচিত হবে? আমারতো কোন পরিচয় নাই। গাঁয়ের লোকজন মজা করে বাদশা বলে ডাকে। মানা করলেও শোনে না। কিন্তু আমিতো বাদশা না-ফকির।’
আমি প্রতিবাদী ভঙ্গিতে বললাম, ‘কে বললো আপনার পরিচয় নাই? আপনি একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। এই পরিচয়ের চেয়ে বড় কোন পরিচয়, বড় কোন সম্মান এ দেশে নেই। মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী সব পরিচয়ই আপনার কাছে তুচ্ছ।’
দাউদ আকস্মিক প্রশ্ন করে, ‘আপনি নাকি পাকআর্মীদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েছিলেন? ওদের হাত থেকে বাঁচলেন কিভাবে?’
বাহরাম বাদশা হেসে বললেন, ‘আমিও মাঝে-মধ্যে অবাক হই। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি-সেদিন বাঁচলাম কিভাবে?’ একটু দম নিয়ে বললেন, ‘সেই মুহূর্তে আমার মাথায় শুধু একটা কথাই দোল দিয়ে যাচ্ছিল, ওরা দখলদার। ওরা এসেছে আমার মাতৃভূমি দখল করতে। আর আমরা লড়াই করছি স্বাধীনতার জন্য। মাতৃভূমি দখল মুক্ত করতে। জয় আমাদের হবেই। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে এলএমজির ট্রিগার চেপে ধরলাম। মনে হলো আমার চারপাশ সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। যেন শুধু আমি একা মাতৃভুমির জন্য লড়াই করছি। তারপর কি হয়েছে আর মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমি হাসপাতালে।
দাউদের চোখ টলমল করছে। ঢোক চেপে বলে, ‘আমি আপনার পা ছুঁয়ে একটু সালাম করতে চাই।’
দাউদের কন্ঠ আবেগে বুজে আসছিল। সে আবেগ আমাকেও স্পর্শ করে। দাউদের কথায় ম্লান হাসলেন বাহরাম বাদশা। বললেন, ‘আমারতো পা নেই। দেশের জন্য উৎসর্গ করেছি। তুমি আমার পা ছুঁবে কিভাবে?’
দাউদের চোখ ভেজা। বলে, যেটুকু আছে তাই স্পর্শ করে আমি আমার জীবন ধন্য করবো। দাউদ আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাদশা ভাইয়ের পায়ের হাটুর উপরের অংশ ধরে বসে থাকে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আমিও বাদশা ভাইয়ের আরেকটি কাটা পা ধরে বসে থাকি।
ফেরার পথে বড় সড়ক ধরে আমরা হাঁছিলাম। আমি দাউদকে বললাম, ‘এই সড়কটি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ বদি সরণী। এই সড়ক দিয়ে হাঁটার কোন অধিকার আমাদের নেই।’
‘কেন?’ দাউদ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে।
শহীদ বদি আমাদের গ্রামের মানুষ। যুদ্ধের সময় অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে লুকিয়ে গ্রামে এসেছিল। কিন্তু খবরটি বড়চাচা মানে তোর বাপ জেনে যায়। তিনি পাকআর্মীকে খবর দিয়ে ডেকে আনেন। পাকআর্মী আর বড় চাচার রাজাকার বাহিনী বদির বাড়ি ঘেরাও করে। তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। বদি আত্মসমর্পণ করে না। সে একাই বিশাল পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। একসময় স্ত্রীর এবং তিনি দু’জনই শহীদ হন।’
এবার দাউদ দু’হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কিছু সময় কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায় ভেজা চোখে। বলে, ‘ঠিকই বলেছিস, এই রাস্তা দিয়ে হাঁটার কোন অধিকার আমাদের নেই। যদি এমন হতো-আমাদের বাপ-চাচা কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। আর তার নামে এই রাস্তার নাম করণ করা হয়েছে-তা’হলে কেমন হতো। হাঁটতে গেলে আমাদের বুকটা গর্বে ভরে উঠতো। আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম, ‘এই দেশটা আমাদের। এই দেশের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে।’  
দাউদ আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সড়ক থেকে আঁল পথে নেমে পড়ে। বলে, ‘তুইও নেমে আয়। এই পবিত্র সড়ক আমাদের কলঙ্কিত পায়ে স্পর্শে অপবিত্র করার কোন অধিকার আমাদের নেই। এ দেশের আলো বাতাসও আমাদের জন্য নিষিদ্ধ।’ বলেই দাউদ আঁল পথ ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।
বাড়িতে ফিরে দাউদ অন্যরকম হয়ে যায়। ছাদে গিয়ে গুম হয়ে বসে থাকে। সন্ধ্যায় চা-নাস্তা খেতে বাবা ডেকে পাঠালে দাউদ তবু ঠাঁয় বসে থাকে। রাতে আমার পাশে শুয়ে বলে, ‘আমি আর লন্ডন ফিরে যাব না।’
‘কেন?’ আমার প্রশ্ন আৎঁকে ওঠার মতো শোনায়।
দাউদ বলে, ‘আমি পিতৃঋণ শোধ করতে চাই।’
‘মানে!’
‘বাবা দেশ-জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যে অপরাধ করেছে-আমি সেই অপরাধের দায় কিছুটা হলেও নিজের কাধে নিয়ে বাবাকে দায়মুক্ত করতে চাই।’
‘কিভাবে?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করি।
দাউদ সরাসরি বলে, ‘যারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর দাবীতে রাস্তায় আন্দোলন করছে আমি সেই আন্দোলনে অংশ নেব।’  
আমি বলি, ‘তোর পরিচয় জানার পর ওরা কি তোকে দলে নেবে?’
আমার কথায় দাউদ থমকে যায়, ভেবে বলে, ‘আমি নিজেই পিতার অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাইব। কাদের মোল্লার ছেলের মতো কসাই পিতার জন্য মায়া কান্না কাঁদবো না। বলবো না আমার পিতা নির্দোষ। বলবো না-বিচারের নামে তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। কসাই কাদেরের ছেলে পিতার জন্য গ্লানিবোধ করেনি। আমি গ্লানিবোধ করছি। কসাই কাদেরের ছেলে হিপোক্র্যাট। কিন্তু আমি সহজ সত্য সবার সামনে তুলে ধরবো। জাতির কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইব। তারপরও কি ওরা আমাকে ওদের সঙ্গে নেবে না?’ দাউদের এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। তারপরও দাউদ ওর প্রশ্নের জবাব পেতে আমার দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকে।*