করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৭ সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





প্যাত্রিক মোদিয়ানোর স্মৃতিশিল্প
কামাল রাহমান
সাহিত্যে এ বছর প্যাট্রিক মোদিয়ানোর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির যোগ্যতা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে পুরস্কার কমিটির ভাষ্য ছিল,‘স্মৃতির শিল্পের জন্য, যার সঙ্গে জাগরুক করেছেন তিনি মানুষের চূড়ান্ত অধরা নিয়তি, এবং উন্মোচিত করেছেন দখলদারিত্বের জীবন-বিশ্ব।’ ২০০৮এ ফ্রান্সের লে ক্লেজিও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মাত্র ছ’বছরের ব্যবধানে আরেকজন ফরাসির সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া একটু অবাক করার মতো বিষয় ছিল বৈকি। যদিও এটা নতুন নয় ওখানে।সাহিত্যের জন্য প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ফ্্রান্সের সুলি প্রুধোম। তারপর বিগত একশ’ চৌদ্দ বছরে আরো চৌদ্দজন ফরাসি সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। পনেরতম নোবেল লরিয়েট প্যাট্রিক মোদিয়ানো। এই পনের জনের মধ্যে এগার জনই ফ্রান্সের নাগরিক। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর অনেকের সামনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, কে এই লেখক, এবং মানুষের অধরা ঐ নিয়তিগুলো কি, যা তিনি উন্মোচন করেছেন?
বেলজিয়ান মা ও ইতালিয়ান ইহুদি বাবার সন্তান প্যাট্রিক মোদিয়ানো। বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল পুরোপুরি নৈরাশ্যজনক ও অনেকাংশে বিরোধপূর্ণ। সরকারী অর্থ সাহায্য নিয়ে স্কুলের পড়াশোনা চালাতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর থেকে দু’বছরের ছোট ভাই রুডি দশ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা গেলে গভীর শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন মোদিয়ানো। মনের উপর তীব্র প্রভাব ফেলেছিল ঐ মৃত্যু। এখনো ঐ বেদনা  বয়ে বেড়ান তিনি।
মূলত নগর-জীবনের লেখক মদিয়ানো। শিল্প ও সংস্কৃতির ধারক প্যারিস নগরীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকর্ম। জার্মান দখলদারিত্বের সময়টাকে সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি এক আত্মজৈবনিক উৎকর্ষ-শিল্প রূপে। তাঁর উপন্যাসগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে সাযুজ্য প্রদর্শন করে। অনেক সময় এমনও মনে হয় যেন আগের পরিচ্ছদগুলোই প্রলম্বিত হয়েছে, অথবা আগের চরিত্রগুলো অন্যসব গল্পে এসে উপস্থিত হয়েছে নতুন এক সৌকর্য নিয়ে। স্মৃতি ও বিস্মৃতি, আপন সত্ত্বার অন্বেষণ, অপরাধবোধ থেকে উদ্ভূত যন্ত্রণা, প্রভৃতি জটিল প্রপঞ্চগুলোর উপর প্রায়শ কেন্দ্রীভূত থাকে তাঁর সকল শিল্প-নির্মাণ। মদিয়ানোর শহর প্যারিস, ও এর ইতিহাস  সাধারণত গল্পগুলোর ভেতর একটা যোগসূত্র তৈরি করে।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর মোদিয়ানোর সাহিত্যকর্মের মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। কিন্তু তাঁর পরিচিতির বিষয়টা একটা জিজ্ঞাসাই বটে। এটার একটা কারণ হতে পারে যে তাঁর বই ইংরেজিতে খুব বেশি অনুবাদ হয়নি। জার্মান, স্প্যানিশ ও সুইডিস ভাষায় তাঁর অনেক অনুবাদ রয়েছে। এর বাইরে যদিও প্রায় তিরিশটি ভাষায় তাঁর অনুবাদ হয়েছে, তবে সে-সব তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। মোদিয়ানোর অনুবাদে কিছুটা দুরূহতাও রয়েছে। তাঁর লেখার বিশেষত হল এর ভেতর অন্তপ্রবিষ্ট রয়েছে কাব্যিক ব্যঞ্জনা, যা খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন তিনি। ঐ সব রচনা সরল অনুবাদ করলে ঐ কাব্যিক ব্যঞ্জনা থাকে না, আবার কবিতার মতো অনুবাদ করে তাঁর স্বরটাকে ধরা যায় না। দ্বিমুখী এই অভিযানে তাঁর রচনা প্রায়শ শিল্পগুণ হারিয়ে ফেলে।
মোদিয়ানোকে দেয়া এবারের পুরস্কার প্রসঙ্গে পাওয়া কোনো কোনো প্রতিক্রিয়া অনুসরণ করে বলা যায়, উত্তর অ্যামেরিকার সাহিত্য ব্যবসায়ীরা ফিলিপ রথ নোবেল পুরস্কার না পাওয়ায় যতটা সোচ্চার হন তার একাংশ প্রতিক্রিয়াও দেখান না হারুকি মুরাকামি, ’নগুগি থিয়োঙ্গো, কিংবা এডোনিসের মতো বিশ্বনন্দিত প্রতিভার নোবেল পুরস্কার না পাওয়ায়। বরং তারা সুইডিস নোবেল কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেন বহুলপঠিত ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিকদের নোবেল পুরস্কার না দেয়ায়। প্রসঙ্গের একটু বাইরে যেয়ে বলা যেতে পারে, নোবেল শান্তি পুরস্কার পুরোপুরি রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বলে ওটাকে শান্তি পুরস্কার না বলে রাজনীতি পুরস্কার বলতে পছন্দ করে অনেকে। পৃথিবীতে তাবৎ অশান্তি সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবর্গ নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে আসছে অনেক দিন থেকে, অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে। তবে এ পুরস্কারটি দেয় নরওয়েজিয়ান কমিটি, সুইডিশ কমিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না এজন্য। এবারের শান্তি পুরস্কার সম্ভবত অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তালেবানদের একদু’টা গুলি খেয়ে কেউ যদি বিশ্ব-শান্তির জন্য অবদান বয়ে আনতে পারে তাহলে মুসলমান বিশ্বে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ পুরস্কার পাওয়ার উপযোগী শিশুকিশোর-কিশোরী রয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার এই নিয়ম যে চালু করেছে ওরা, এর পেছনে নিশ্চয় কোনো না কোনো যুক্তিও দাঁড় করিয়েছে।
এ প্রশ্নও দেখা দিতে পারে যে এবার মোদিয়ানোর নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় এত অবাক হয়েছে কেন অনেকে? এত সীমিত হয়ে রয়েছে কেন তাঁর পরিচিতি? এটা ভেবে নেয়া যেতে পারে যে এসবের পেছনেও কাজ করেছে ঐ সাহিত্যের রাজনীতি! সাহিত্য ব্যবসায়ীরা সাধারণত নিজেদের পোষা লেখকদের ছাড়া অন্যদের জন্য কিছু বলে না। এটাই স্বাভাবিক। এদের আনুকূল্য না পেয়ে টমাস পাইঞ্চোন অথবা জয়েস ক্যারোল ওটসের মতো অনেক প্রতিভাবান ও ভিন্নমুখী সাহিত্যিকেরা অ্যামেরিকাতেই আলোচনার বাইরে থেকে যান অনেকাংশে। ইংরেজি ভাষার প্রাধান্যে ইউরোপীয় অন্যান্য ভাষাগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ায় একটা কলরব উঠেছে সম্প্রতি। বাস্তবে খুব যে কার্যকর হচ্ছে ওটা, তাও না। যথেষ্ট ফলপ্রসূ একটা বিষয় ছিল, এক সময় রাশিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী দেশ থেকে অনুবাদক আনিয়ে রাশিয়ার সাহিত্যগুলো অনুবাদ করাত। শত শত রুশ বইয়ের অনুবাদ সে-সময় বাংলা সহ অন্যান্য ভাষাভাষীরা পেয়েছে। ঐসব বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ তখনও ছিল। রুশ সরকার সময়োপযোগী ঐ উদ্যোগটা না নিলে ওগুলো ইংরেজি থেকে অন্যান্য ভাষায় এত ব্যপকভাবে অনূদিত হত না। এ বিষয়টা সব ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য মনে করা যেতে পারে। অনেক লেখকেরই বিশ্বব্যাপী অনুবাদ হয় সাধারণত তাঁদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর। নোবেল পুরস্কার না পাওয়া অসংখ্য ভালো লেখক বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পাওয়ার সুযোগ পাননি। এটা এক নঙর্থক দিক। নোবেল পুরস্কারের বিকল্প অথবা কাছাকাছি মানের আরো কিছু পুরস্কার থাকা হয়তো উচিত ছিল এ জগতে।
ধরা যাক, সৈয়দ শামসুল হক, অথবা হাসান আজিজুল হক, কিংবা মহাশ্বেতা দেবীকে যদি এ পুরস্কার দেয়া হত তাহলে বিশ্বব্যাপী এর প্রতিক্রিয়া কি হত! বিশ্বাস করা যেতে পারে যে শিল্পমানের দিক থেকে এঁদের, বা আরো অনেকের সাহিত্যকর্ম মোদিয়ানোর ‘স্মৃতির শিল্প’ থেকে কোনো অংশে ঊন নয়, এভাবে সাহিত্য বিচার করা যদিও ঠিক না। বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের প্রায় ডজনখানেক সাহিত্যিক যে রয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে বিশ্ব-পাঠকদের অবগত করানো হয়েছিল বলে মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। নিজস্ব নির্মাণ বা শিল্পকর্মের বাইরে একজন প্রকৃত শিল্পী কদাচ নিজেকে নিজে উপস্থাপন করেন। তাঁর জন্য এগিয়ে আসতে হয় সমাজকে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে একটা সংঘবদ্ধ গোষ্ঠিকে, বা প্রতিষ্ঠানকে। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে বাংলাদেশে এটা হয় না বা নিকট ভবিষ্যতে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও অনুমান করা যায় না। বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করানোর বিকল্প তো কিছু নেই। বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে নোবেল কমিটির কোনো যোগাযোগ আছে কিনা বা এরা কেউ কখনো কারো নাম পাঠায় কিনা তা জানারও কোনো সুযোগ নেই।
ফরাসি ভাষার সাহিত্যের সামনে যে সুযোগটি রয়েছে তার একাংশও বাংলা ভাষার সাহিত্যের সামনে নেই। ইউরোপীয় একটা প্রধান, ও ব্যাপক ঔপনিবেশিক ভাষা হওয়ার সুবাদে এমনিতেই ফরাসি সাহিত্যের বাজার রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। তারপর কোনো সাহিত্যিক কিছুটা পাঠকপ্রিয়তা পেলে সহজেই অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে তাঁর। বাংলার ক্ষেত্রে এটা ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আঞ্চলিকতাদুষ্ট মানসিকতার কারণে ভারতীয় অন্যান্য ভাষায় বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ প্রায় হয়ই না বলা চলে। বাংলায় যদিও ভারতের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের অনুবাদ অনেক হয়েছে ও হচ্ছে।
গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে প্রতি দুবছরে একটা করে বই প্রকাশ করে চলেছেন মোদিয়ানো। তাঁর ভাষ্যমতে সব মিলিয়ে একটা অতি দীর্ঘ রচনা বিভিন্নভাবে ও বিচ্ছিন্নভাবে লিখে চলেছেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে অনেকটা অন্তর্মুখী ও আবেগপ্রবণ মোদিয়ানো। বাইরের জগতের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখেন না। বাস করেন এক বিষাদ-করুণ কল্পনা জড়ানো মায়াজগতের অলৌকিক ঘোরের ভেতর। এমনকি কথা বলতে যেয়েও মাঝে মাঝে শব্দ খুঁজে পান না তিনি, বা বাক্য শেষ করতে পারেন না। তাঁর কলম থেকে কীভাবে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো যাদুকরী শব্দ সব বেরিয়ে আসতে পারে তা ভাবার বিষয়ই বটে। ফ্রান্সের খ্যাতনামা লেখক হলেও বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচিতি নেই বললেই চলে। কো উন, বেন ওকরি, মার্গারেট এটউড প্রমুখ সাহিত্যিকের কাছাকাছিও যেতে পারেনি তাঁর পরিচিতি ।
১৯৬৮ সনে মোদিয়ানোর প্রথম বই ‘তারকাটি রাখো’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ফ্রান্সে তাঁর প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত। বাস্তব ও কল্পজগতের মিশেলে এক অভিনব ঘোরের জগত নির্মাণ করেন তিনি, যা হেঁয়ালির মধ্য দিয়েও রূঢ় বাস্তবতার বেদনা প্রকাশ করে। তাঁর দেশের এক নিকট অতীতের কষ্টদায়ক ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি। ক্লেশকর ও বর্ণনা-অযোগ্য এ অবস্থাটা তুলে ধরতে অন্যেরা হয়তো বিড়ম্বিত হত, কিংবা দ্বিধা বোধ করত। কারণ, ঐ সময়টাতে গ্লানি ভিন্ন কোনো পৌরুষ ছিল না সেখানে। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর সবশেষ বই ‘তোমার পড়শিগ্রামে যেন হারিয়ে না যাও তুমি’ খুব সহজেই ফ্রান্সে বেস্ট-সেলারের তালিকায় উঠে এসেছিল। তাঁর বইয়ের বিক্রয় লক্ষাধিক কপি ছাঁড়িয়ে যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন বহুলপঠিত লেখক বলা যেতে পারে তাঁকে এখন। অনুরাগী পাঠকেরা তাঁকে তাঁর নিজস্ব সাহিত্যিক ঘরাণার লেখক বলে মনে করে, বালজাক অথবা শেক্সপীয়্যারের যেমন রয়েছে নিজস্ব ঘরাণা। মোদিয়ানো ঘরাণার একটা নাম দিয়েছে ফরাসি পাঠককূল: মোদিয়ানেস্ক, যা বিশেষভাবে বোঝায় কোনো অনিশ্চয়তা বা দোলাচল।
ভিন্ন এক কল্পজগত সৃষ্টি করতে সক্ষম হন তিনি। তাঁর উপন্যাসগুলোর প্রতিটা এক অনন্য স্মৃতিবিশ্ব নির্মাণ করে। প্রাচীন অনচ্ছ আলোর ক্ষয়ে যাওয়া প্রবাহের মতো। অথবা পুরোনো তুলোট কাগজে লেখা, যা গোপন কোনো সঙ্কেত উদ্ধার করে এক গভীর নিরীক্ষার পর। প্যারিসের নগর-সভ্যতার বিভিন্ন দিক সুবিস্তারিত বর্ণনা সহ ফুটে ওঠে তাঁর লেখায়। এক আত্মিক প্রগাঢ় ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকে সে-সব। তাঁর চরিত্রগুলো সর্বত্র খুঁজে বেড়ায় বিভিন্ন আপাতজটিল অথচ নিরীহ সব প্রশ্নের উত্তর। এবং তিনি নিজেও গভীর প্রত্যয় নিয়ে খুঁজে বেড়ান সেই সব অতীত স্মৃতি, ও বিস্মৃতিগুলো। তাঁর লেখালেখির প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে ছোট ভাই রুডির অকালমৃত্যু, পিতার অবহেলা, জার্মান আগ্রাসনের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা, সময় ও মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন স্থানের বিস্তারিত পরিচয়, অতীতের বিচিত্র সব অনুষঙ্গ, প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বচ্ছ উপস্থাপন প্রভৃতি।
তাঁর কয়েকটি উপন্যাসের বিষয়বস্তু লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে তাঁর রচনার গভীরতা ও নোবেল কমিটির বিবেচনার যাথার্থ্য। একুশ বছর বয়সে লেখা মোদিয়ানোর প্রথম উপন্যাস ‘তারকাটি রাখো’ ফ্রান্সের ‘রোজার নিমিয়ার’ পুরস্কার ও ‘ফেনিওন’ পুরস্কার পায়। মোদিয়ানোর ঐ বইয়ের নামটাও এক শব্দের খেলা। যা প্রকাশ করে ঐ তারকা, যা নাৎসিরা বাধ্য করেছিল শেফার্দিক ইহুদিদের পোশাকের সঙ্গে পরিধান করতে। ‘প্লেস দে এল’ইটোয়েল’  হল প্যারিসের কেন্দ্রে অবস্থিত ‘আর্চ দে ট্রায়োম্ফে’র চারদিকের বর্গাকার জায়গাটি।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বই ‘গুপ্ত দোকানগুলোর সড়ক’, ইংরেজি সংস্করণে ‘নিখোঁজ মানুষ’। বইটা ১৯৭৮ সনে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘প্রি গোকূঁ’ পেয়েছিল। এটার কাহিনী অনেকটা সহজ সরল। কিন্তু মোদিয়ানোর লেখার বৈশিষ্ট্যমূলক, অনুসন্ধানপ্রবণ ও স্মৃতিতাড়িত। এক গুপ্তচরের নিয়োগকর্তা ঠিক করেছে যে ঐ কার্যালয় বন্ধ করে দেবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় তার নতুন পাওয়া অবসর বা মুক্ত সময়টাকে অন্যভাবে ব্যবহার করার জন্য। জীবনের শুরুর দিকে ওর পরিচয় হারিয়ে গেছিল একটা রহস্যজনক দুর্ঘটনার পর। অনেকটা সত্তর দশকের বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো। ওর সবশেষ তদন্তটার উপর ভিত্তি করে পাওয়া বিভিন্ন অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায় সে। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা এসে উপস্থিত হয় ওর সামনে, নিজেকে খুঁজে বের করা। বিভিন্ন যোগাযোগের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত একটা ভুল পরিচয় পায় সে।
বইয়ের মূল চরিত্র গী’ রোলাঁ আংশিক স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছে। পেশা হিসেবে এক তদন্তকারীর জীবন শুরু করার আগের অংশটা প্রায় পুরোপুরি মুছে গেছে জীবন থেকে।  এমনকি ওর নাম ও জাতীয়তাও এক রহস্য ওর কাছে। অন্যদের জীবনের সমস্যা মেটানোর পর নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকায় সে। রোলাঁর জীবনের চরম ও কঠিন মুহূর্তটি ঘিরে উপস্থিত হয় তার অতীত। নাৎসিদের দখলে থাকা ফ্রান্সের ঐ সময়টা অবশ্য খুব বেশি অবাক হওয়ার মতোও নয়। এমন এক সময় ওটা যার সবকিছু ভুলে থাকতে চায় অনেকে। রোলাঁর ঐ সময়টা প্রায় পুরোপুরি মুছে গেছে স্মৃতি থেকে। এমন এক ভঙ্গি ওটা, যা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। স্মৃতির ঐ বিচ্ছিন্ন  টুকরোগুলো সংগ্রহ করে একটা রূপ দিতে চায় সে এখন। সরাসরি অনুসরণ করে সে বিস্ময় জড়ানো সব ইঙ্গিত, ছড়িয়ে থাকা প্রমানচিহ্ন, এলোমেলো তথ্যসূত্র। পাজ্ল-এর মতো একটা টুকরোকে বসায় আরেকটার পাশে। আলো ফেলে অন্য আরেকটা অংশে। কিন্তু ঐ পাজ্ল-এর সবটা জোড়া লাগাাতে সক্ষম হয় না। কোনো এক পর্যায়ে রোলাঁর মনে হয় ভুলে যাওয়া জীবনের ঐ সময়টায় রাশিয়ার অভিবাসীদের সঙ্গে অভিযুক্ত ছিল সে। অন্য সম্ভাবনাগুলো বলে, অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল সে হলিউডে। অন্য আরেকটা সূত্র বলে ল্যাটিন আমেরিকার কূটনৈতিক মিশনের সঙ্গে ছিল সে, ওর পারিবারিক নাম ছিল ম্যাকএভয়, যা আইরিশ নামের কথা বলে। ফ্রান্স ছেড়ে গেছিল সে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আগে। অথবা সে এক গ্রীক, নাম স্টার্ন। এক দালাল, যে বাস করত রোম অথবা প্যারিসে। নাহয় অদ্ভুত এসব পরিচয়ের একটা মিশেল। নিয়তি-নির্দেশিত ও অস্বচ্ছ এক সত্ত্বা। এমন সব প্রহেলিকাপূর্ণ অতীত অভিজ্ঞান রোলাঁকে স্মৃতি ও বিস্মৃতির ভেতর দোলায়মান রাখে। যেসব মানুষকে সে জিজ্ঞাসা করে এসব বিষয়ে তাদের প্রায় সবারই রয়েছে এমন একটা করে বলার মতো গল্প। কিন্তু এসব শোনার জন্য কোনো অনুকম্পা অথবা আবশ্যিকতা একজন শ্রোতার নাও থাকতে পারে। হারিয়ে যাওয়া ঐ সব মানুষের খোঁজে সে শত শত সূত্র অনুসরণ করে। বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে আসে হাজার মাইল দূরত্ব। কিন্তু কোনো হিসাব মেলাতে পারে না। হয়তো আরো হাজার মাইল এগিয়ে এসেও কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারবে না সে। রহস্যটার শেষ প্রান্তে পৌঁছোতে পারবে এভাবে, না আরেকটা বদ্ধ প্রান্তে যেয়ে উপস্থিত হবে, তাও জানে না। এমন সব জিজ্ঞাসা সব সময় তাড়িত করে ওকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে রোলাঁ। নিজেকে জিজ্ঞেস করে, সায়াহ্নকালে কি ক্ষয়ে যায় এ জীবন? যে মানুষটাকে খুঁজছে সে নিজের ভেতর তাকে হয়তো আর কোনো দিনই পাবে না। বালুর মধ্যে হেঁটে চলা মানুষের পায়ের ছাপ যেমন ক্ষণিকের, তেমনি মানুষের জীবনের সব পথ চলা। গী’ রোলাঁর ভাষ্য: আমি কিছুই না। কিছুই না কিন্তু একটা ছায়া। একটা অন্তহীন কায়া। শরীরের গড়ণটা এখন ফুটে উঠেছে আমার, এই সন্ধ্যায়, আলো-আঁধারি কাফেটার সামনে। অপেক্ষা করছি বৃষ্টি থামার জন্য। ঝড়জল শুরু হয়েছে। হিউট ছেড়ে গেছে আমাকে কয়েক ঘণ্টা আগে।  শেষবারের মতো আমাদের দেখা হয়েছিল এজেন্সি অফিসের ভেতর । বরাবরের মতো ওর বিশাল ডেস্কের সামনে বসে ছিল হিউট। কালো রঙের কোটটা পরনে ছিল ওর, যেন অফিস ছেড়ে যাওয়ার একটা আবহ তৈরি হয়েই ছিল। ওর উল্টো দিকে চুপচাপ বসে ছিলাম আমি। ক্লায়েন্টের জন্য রাখা একটা চেয়ারে। আমার চোখে বিম্বিত হচ্ছিল বর্ণালি সেডের উজ্জ্বল আলো। ‘আচ্ছা, ওখানে আমরা, গী’. . .  এই তাহলে. . . ’ বলেছিল হিউট, একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে। ওর ডেস্কে পড়ে ছিল একটা খয়েরি রঙের নথি। ওটা হয়তো ভয়ার্ত ভঙ্গির এবং ফুলোফুলো মুখের এক ছোট্ট বাদামি মানুষের, যে আমাদের নিয়োগ করেছিল ওর স্ত্রীকে অনুসরণ করার জন্য। ঐ বিকেলে পল-ড্রেমার এভিন্যূর কাছে রুই ভিটালের একটা আবাসিক হোটেলে সে দেখা করে আরো একজন বাদামি মানুষের সঙ্গে যার মুখও ফুলোফুলো। হিউট ওর দাড়িতে আঙ্গুল বুলিয়েছিল চিন্তিতভাবে। গ্রিজলি ভালুকের লোমের মতো ছিল ওগুলো, এবং ছোট করে ছাঁটা। কিন্তু ঢেকে রেখেছিল ওর পুরো চিবুক। বড় বড় ও স্বচ্ছ নীল চোখ দুটো ওর একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো। ডেস্কের বাঁদিকে ছোট্ট আরেকটা চেয়ার। ওখানে বসতাম আমি কাজের সময়ে। হিউটের পেছনে অর্ধেকটা দেয়াল ঢেকে রেখেছে গাঢ় রঙের কাঠের তাক। ওখানে সারিবদ্ধ আছে বিভিন্ন সড়ক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তথ্য-সম্বলিত ডাইরেক্টরি ও ইয়ারবুক। হিউট প্রায়ই বলত, এগুলো হল তোমার ব্যবসার প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। কখনো ফেলে দেয়া যায় না এসব। এটা ভেবে নিত পার যে বিগত পঞ্চাশ বছরের এই ডাইরেক্টরি ও ইয়ারবুকগুলো হচ্ছে তুমি কল্পনা করতে পার এমন একটা ভ্রাম্যমান পাঠাগারের খুব মূল্যবান সামগ্রী।  এগুলোয় ধরে রাখা তথ্য সব ধারণ করে আছে মানুষ, বিষয়, ও মুছে যাওয়া পৃথিবী, যেগুলোর সাক্ষী শুধু ওরাই।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়ে তাঁর এই উপন্যাস ‘গুপ্ত দোকানগুলোর সড়ক’ অ্যামেরিকায় বিক্রি হয়েছিল মাত্র আড়াই হাজার কপি। উত্তর অ্যামেরিকায় কখনোই পাঠকপ্রিয়তা পাননি মোদিয়ানো। আশির দশকে মিলান কুন্ডেরার যেমন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ছিল, অথবা আমোস টুটুওলার যেমন ব্যাপক পরিচিতি ছিল, কিংবা এখন হারুকি মুরাকামি যেমন অতি জনপ্রিয়, এসবের কাছাকাছিও যেতে পারেননি মোদিয়ানো। সাহিত্যজগতে তারকাখ্যাতি কখনোই ছিল না তাঁর। বলা যায়, কার্ল কঁসগর্দের মতো পাঠকপ্রিয়তাও তাঁর ছিলনা। এমনকি কঁসগর্দও হালে অনেক পাঠক পাচ্ছেন। নোবেল পুরস্কার নিশ্চয় এখন মোদিয়ানের সামনে অসংখ্য পাঠকের দুয়ার খুলে দিয়েছে। ঊনসত্তর বছর বয়সে নিশ্চয় এটা উপভোগ করবেন মোদিয়ানো। তবে মনে হয় না যে লেখালেখিটা খুব পছন্দ করেন তিনি। কুয়াশার মধ্য দিয়ে গাড়ি চালানোর মতো এটা তাঁর কাছে। ‘তুমি জানো না কোথায় যাচ্ছ, তুমি শুধু জানো যে তোমাকে যেতে হবে।’ সাধারণত সাক্ষাতকার দিতে চাইতেন না তিনি। বিরল এক সাক্ষাতকারে একবার বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে একটা পৌনঃপুনিক স্বপ্ন ছিল আমার যে আর কখনো লিখতে হবে না, আমি মুক্ত। হায়, মুক্ত না আমি, এখনো ঐ একই ভূখ-ে বিচরণ করে চলেছি, ক্লান্তিকর ঐ মনোভাব নিয়ে যা কখনো অশেষ নয়।’
মদিয়ানোর আরেকটা উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘মধুচন্দ্রিমা’য় দেখা যায়, ওটার মূল চরিত্র, বা নায়কটিকে তার স্ত্রী ও বন্ধুরা বিদায় জানিয়েছে প্যারিস বিমান বন্দরে। একটা ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়ার কথা ওর। কিন্তু রিওর মাটিতে পা রাখেনি সে কখনো, রয়ে যায় প্যারিসেই। রহস্যময়ী এক নারীর জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ জড়ো করে অবশেষে এক অজানার অনুসন্ধানে হারিয়ে যায় সে। ১৯৯০এ প্রকাশিত এ উপন্যাসটির কাহিনী এরকম: এক ডকু-ফিল্ম নির্মাতা স্ত্রী ও পেশা ছেড়ে সময় কাটাতে শুরু করে প্যারিসের বাইরে। বিশ বছর আগে দেখা এক উদ্বাস্তু দম্পতির স্মৃতি চারণ করে বর্তমানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে সব কিছু। ছোট্ট ঐ শহরের মানুষগুলোর আচরণ এখন এমন যেন কোনো যুদ্ধই ছিল না সেখানে। পুরুষেরা পোশাক পরে থাকে সমুদ্রতীরের পাজামা অথবা ট্রাউজার। আর মেয়েদের পরনে থাকে হালকা রঙের ঢিলেঢালা স্কার্ট। মানুষগুলোর বয়স ইংগ্রিড ও রিগো থেকে অন্তত বিশ বছর বেশি। ওদের দেখে অবশ্য ওরকম মনে হয় না। রোদে পোড়া  ত্বক ও খেলোয়ারসুলভ কাঠামো নিয়ে ওরা ঘুরে বেড়ায়। যতœ নিয়ে অযতেœ থাকার ভান করে। গ্রীষ্ম পেরিয়ে যাওয়ার পর অবস্থাটা কেমন হবে ভাবেও না একবার। খাবারের আগে নেয়া মদ্যপানের টেবিলে ঠিকানা বদল করে ওরা। ভালো কোথাও থাকার জায়গা খুঁজে পাবে কি ওরা এই শীতে? ওদের কেউ কেউ পছন্দ করে শহরের একটা অংশ। সেখানে থাকার জায়গা ঠিক করা শুরু করে। অন্যদের আবার আজুর ছেড়ে যাওয়ার কোনো আগ্রহই নেই। এটা অবশ্য সম্ভব হতেও পারে। কারণ সাদা রঙের পুরোনো একটা হোটেল আবার চালু হতে যাচ্ছে। সমান্তরাল পাইন গাছের সারির মধ্য দিয়ে দেখা যাওয়া ঐ হোটেলটায় হয়তো নিরাপদ থাকবে ওরা। ওদের সূর্য-ঝলসানো বাদামি ত্বকের নিচে ও চেহারায় ভেসে থাকা তীব্র মনোবেদনার চিহ্ন উদ্ধার করা যেতে পারে। এমনটা ভাবে ওরা যেন পাকাপাকিভাবে স্থানবদল হতে যাচ্ছে ওদের। এমন একটা জায়গা খোঁজে ওরা যা যুদ্ধের কালো হাতের স্পর্শের বাইরে রয়েছে এখনও। আর এই মরুদ্যানটা সব সময়ের জন্যই রয়ে যাবে দুষ্প্রাপ্য। সব কিছুরই রেশনিং শুরু হয়েছে এখানে। যে কোনো কিছুর জন্য অবশ্যই ভাবতে হবে তোমাকে। তোমার নৈতিকতাকেও অবজ্ঞা করতে পার না তুমি। এই অলস দিনগুলো এমন এক অনুভূতি দেয় তোমাকে, যেন গৃহবন্দি তুমি। তোমার মস্তিষ্কে একটা শূন্যতা সৃষ্টি করতে হবে। আকাশের ঐ উজ্জ্বল সূর্যের প্রখর আলোর নিচে অবশ করে ফেলতে হবে নিজেকে।  মৃদুমন্দ বাতাসে চোখ বন্ধ করে পাম গাছের শান্ত ছায়ার নিচে ধীরে ধীরে আন্দোলিত হবে তুমি। ইংগ্রিড ও রিগো এই একই ধরনের জীবন যাপন করছে। এই মানুষেরা  ভুলে যাচ্ছে যুদ্ধের বিভীষিকা। কিন্তু ওরা ঐ মানুষগুলো, যারা ভুলে থাকে যুদ্ধের নৃশংসতা, তাদের থেকে ভিন্ন এক পথ বেছে নেয় নিজেদের জন্য। ওদের সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত থাকে, এবং এড়িয়ে যায় ওদের। শুরুতে, ওদের যৌবন দেখে অবাক হয়েছিল সবাই। ওরা ভাবত, বাবা-মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা, নয়তো ছুটি কাটাচ্ছে!  রিগো জবাব দিয়েছিল ‘মধুচন্দ্রিমা যাপনে আছি আমরা।’ খুব সহজেই সে বলেছিল ওটা। ওদের ঐ জীবন মানুষগুলোর  অবাক হওয়া থেকে অনেক দূরে। শহরের মানুষগুলোকে আবার নিশ্চিত করে এটা যে এখনো মধুচন্দ্রিমায় যেতে পারে যদি ঐ তরুণেরা, তাহলে এর অর্থ, অবস্থাটা এত হৃদয়বিদারক না। পৃথিবীটা তো এখনো ঘুরছে সূর্যের চারদিকে।
‘ক্যাথেরিন সার্টিচিউড’ একটা শিশুতোষ বই। রহস্যপূর্ণ, ও উত্তর না দেয়া শত শত প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওখানে। স্মৃতিবিধুর, মজার একটা গল্প, আলো ফেলে এক রহস্যঘেরা মায়ের উপর। প্যারিসে ওর শৈশবের স্মৃতিগুলোর উপর। এটার নির্মাণশৈলীও অভিনব, ও মোদিয়ানেস্ক স্মৃতিশিল্প। নিউইয়র্কে তুষার ঝরছে এখন। ৫৯তম সড়কের ছোট্ট এপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আমি একটা ভবনের দিকে। সামনের রাস্তা ছাড়িয়ে, যেখানে একটা নাচের স্কুল পরিচালনা করি আমি। জানালার শার্সির বড় কাচের পেছনে নাচের ছাত্রীরা থেমে আছে। ওদের মনোনিবেশী কাজ ও অধ্যবসায়ী অনুশীলনের একটা বিরতি। নাচের মাঝখানে যেমন একটা পদক্ষেপের বদল। আমার কন্যা, কাজ করে আমার সহকারী হিসেবে, ওদের দেখাচ্ছে জ্যাজ নাচের একটা মুদ্রা। আর ক’মিনিটের মধ্যে ওখানে যেয়ে পৌঁছোব আমি। ঐ ছাত্রীদের মধ্যে রয়েছে ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে, যে মোটা কাচের একটা চশমা পরে থাকে। ক্লাশ শুরু হওয়ার আগে একটা চেয়ারের উপর চশমাটা রেখে দেয় সে। মাদাম দেসমাইলোভার ক্লাশে যেমনটা করতাম আমি ওর বয়সে। নাচের সময় চশমা পরতে পার না তুমি। স্পষ্ট মনে করতে পারি মাদাম দেসমাইলোভার ঐ কথাগুলো। দিনের বেলা তাই চশমা না পরার অভ্যেসটি গড়ে তুলেছিলাম। মানুষের গড়ণ, দেহরেখা, অন্যান্য জিনিসের আকার ও স্পষ্টতা সব হারিয়ে যেত আমার দৃষ্টি থেকে। সবকিছু দেখাত ঝাঁপসা। এমনকি শব্দগুলোকেও মনে হত জড়ানো। চশমা ছাড়া আমার পৃথিবীটা হারিয়ে ফেলত ওটার সব কর্কশতা। আমার কোলবালিশটার মতো কোমল হয়ে যেত ওটা। ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমার চিবুক রাখতে পারতাম ওখানে। ‘তুমি কি দিবাস্বপ্ন দেখছ, ক্যাথেরিন?’ বাবা হয়তো জিজ্ঞেস করত। তারপর বলত, ‘চশমাটা পরা উচিত তোমার।’ সুবোধ বালিকার মতো আমি পরে নিতাম ওটা, যেমন বলত বাবা। সবকিছু আবার ফিরে পেত ওগুলোর প্রকৃতাবস্থা ও সৌষ্ঠভ। চশমাটা যখন চোখে থাকত, পৃথিবীটাকে দেখাত ঠিক যেমন ছিল ওটা। আর কোনো স্বপ্ন দেখতে পারতাম না আমি।
‘ডোরা ব্রুডা’ উপন্যাস এক কিশোরী ডোরা ব্রুডার গল্প। নাৎসিদের ফ্রান্স দখল করে রাখার সময় ওর কনভেন্ট স্কুল থেকে হারিয়ে যায় সে। ওর ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা জানার জন্য এক শুভানুধ্যায়ীর অনুসন্ধিৎসা, নিজের পরিবারের ইতিহাসের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা, মানুষের অন্তর্জগতের উপর হৃদয়সংহারী সব আঘাত, এ রকম বিভিন্ন অনুষঙ্গের অভিনব উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এর কাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হারিয়ে যাওয়া শত শত মানুষের গল্প-গাথা এটা।
‘ঝুলন্ত বাক্যগুলো’ তাঁর ছোট্ট তিনটে উপন্যাসের একটা সঙ্কলন। প্রতিটা উপন্যাসই এর আগে এককভাবে বেরিয়েছিল। এ তিন উপন্যাসও মোদিয়ানোর স্মৃতিজাগানো ও চিরাচরিত গল্প বলার ধরন এড়িয়ে যায়নি। জীবনের কঠিন ও অলংঘ্য সত্য, ও অন্যদের কাছ থেকে শোনা গল্পের সংমিশ্রণ, এক আত্মজৈবনিক কল্পকথনের মতো মনে হয় এ উপন্যাস তিনটে। তাঁর পাঠককে এক স্বপ্নঘোরের ভেতর নিয়ে যান মোদিয়ানো। বাবা-মা হারানো শিশু, রহস্যময় পিতামাতা, ভুলে যাওয়া সব বন্ধু-বান্ধব, অচেনা আগন্তুক, হেঁয়ালিপূর্ণ ও অতিবাস্তব চরিত্রের অঢেল সমাহার ঘটিয়েছেন তিনি। এবং এমন সব প্রেমগান রয়েছে লেখাগুলোয় যা এখন আর কেউ গায় না প্যারিসে। নাৎসি আগ্রাসনের সময়ে অকালে ঝরে যাওয়া ফুলের কষ্ট, সাংগীতিক বিষাদ-গদ্য, মানুষের অন্তর্বেদনা, ক্ষোভ ও অসহায়ত্ব এক নতুন উদ্ভাবনী শক্তিতে অনন্য রূপে তুলে এনেছেন মোদিয়ানো।
পুরস্কার প্রদানের পেছনে যে বিবেচনাগুলো কাজ করে সাধারণত তা খুব জোরালোভাবে উপস্থাপন করে নোবেল কমিটি। এর অনেক কিছু আবার সাধারণ পাঠকের মাথার উপর দিয়ে বয়ে যায়। লে ক্লেজিওকে পুরস্কার দেয়ার কারণ হিসেবে তাঁদের বিবেচনা ছিল: ব্যতিক্রমধর্মী ও নতুন ধরনের এক কাব্যিক অভিযাত্রা ও পরমানন্দের অনুভূতি দেয়া অনন্যসাধারণ এক শিল্প, চলমান সভ্যতা ছাড়িয়ে এক নতুন মানবতার উদ্ভাবক, প্রভৃতি। আবার এ ধরনের বাগাড়ম্বর ছাড়া খুব সাদাসিধে বিবেচনায় এলিস মনরোকে পুরস্কারটি দেয়া হয়েছিল গত বছর: ‘সাম্প্রতিক ছোট গল্পের গুরু’ এই আখ্যায়। আর এ বছর পুরস্কার দেয়ার পেছনে যে ব্যাখ্যাটি দেয়া হয়েছে তা প্রণিধানযোগ্য।  ‘মানুষ বেঁচে থাকে তার স্মৃতিতে, এই স্মৃতিকে শিল্প করে তুলেছেন মোদিয়ানো।’ এ সময়ের মার্শেল প্রুস্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে তাঁকে। নোবেল কমিটির এ বিবেচনাটিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যথার্থ মনে হয় তাঁর রচনার সংস্পর্শে এসে।