নারীর অনড় মিত্র তিনি! পুরুষতান্ত্রিক বিধান ও বিধিগুলোর পীড়ন-ক্ষমতা সম্পর্কে সজ্ঞান। নারীকে শৃঙ্খলিত করে রাখার পিতৃতান্ত্রিক শেকল বা কৌশলগুলোকে স্পষ্ট করেই চেনেন তিনি! তিনি রাবেয়া খাতুন! তাঁর সমকালীন বা পরবর্তী নারীলেখকদের অধিকাংশই যেখানে শেকলের সৌন্দর্যের স্তব-মুখর, সেখানে রাবেয়া খাতুন শেকল ভাঙার উপায় অন্বেষণ করেন! তিনি উচ্চকণ্ঠ বিদ্রোহী নন! বরং তিনি মানেন যে, সাড়া-শোরগোল জাগানোর চেয়ে, শেকল ভাঙার উপায় বের করাটাই সবচেয়ে জরুরি! তিনি শেকল ছিন্ন করার কর্মে ব্যাপৃত থেকেছেন, নিঃশব্দে!
তাঁর দুটি উপন্যাস ‘মধুমতী’ (১৯৬৩) এবং ‘এই বিরহকাল’ (১৯৯৫) আমাকে, বহুকাল হয় অভিভূত করে রেখেছে! শিল্পিতায় অসামান্য বলে এ দুটি উপন্যাস আমাকে মুগ্ধ করে রাখেনি, বরং এদের আমি অত্যন্ত মূল্যবান বলে গণ্য করি এ কারণে যে, এ উপন্যাস দুটিতে মুদ্রিত হয়ে আছে নারীর শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার আকুলতা ও ক্রোধের পরিচয়! আর তার আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের বিশদ বিবরণ।
রাবেয়া খাতুনের নারী বিপন্ন এক মানুষ, যার শত্রু অনেক! তার সহায় ও সম্বল নেই; কিন্তু তার অস্তিত্বকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে অদৃশ্য, কঠিন শেকল! সে জানে না, নিজেকে আদপেই সে ওই শেকলের বেড় থেকে মুক্তি দিতে পারবে কি না; কিন্তু সে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টাটা ছাড়ে না! ওই চেষ্টা চালানোর সময়ে সেই বিপন্ন নারীর সহায় হয়ে আসে তারই মতো আরেক নিঃসম্বল নারী! রাবেয়া খাতুন রচনা করেন নারীর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত, নির্দেশ করেন নারীর মুক্তির পথ, এবং তুলে ধরেন পুরুষের ইতরতা ও অনৈতিকতার পরিচয়! ওই ইতরেরা নারীর জীবনকে কতটা নারকীয় করে তোলে, তিনি তার তন্ন তন্ন বিবরণও রচনা করেন! তবে রাবেয়া খাতুন এও বিশ্বাস করেন যে, নারীর বড় মিত্রও হতে পারে পুরুষই! যদিও সেই পুরুষের সঙ্গে হয়তো নারীর কদাচিৎ দেখা হয়! বা হয়তো কখনোই দেখা হয় না!
‘মধুমতী’ গ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখা। এটি সম্পূর্ণতই নারীদের আখ্যান! ওই নারীরা তাদের জন্য তৈরি করা পুরুষতন্ত্রের ছাঁচমাফিকই জীবনযাপন করে। প্রাণপণে তারা তাদের মধ্যবিত্ত সংসার ও প্রভুত্ব ফলানো স্বামীর জন্য খাটে। নিষ্ঠার সঙ্গে তারা পালন করে সকল প্রথা। সংসার ও স্বামীর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তুমুল চেষ্টাটাও করে চলে! কিন্তু তারা প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়! ব্যর্থ হয় নিজের কারণেই! কারণ, তাদের ভেতরে যে নারীটি আছে, সে পুরুষতন্ত্রের দীক্ষামাফিক অন্ধ, তুষ্ট, নিদ্রিত হবার প্রতিভা রাখে না!
এই নারীরা সংসারে বসতকারী পুরুষদের চেয়েও ধীশক্তিসম্পন্ন ও সজ্ঞান! তারা গভীরভাবেই অনুধাবন করে উঠতে পারে যে, কোন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথাটি তাদের জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছে! ওই প্রথাটির নাম- বিবাহ! কিন্তু নিরুপায় তারা, ওই প্রথার পীড়ন বরদাস্ত করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই! পুরুষের সংসার ও প্রথার গণ্ডির মধ্যে বাস করে তারা, ওই গণ্ডির শ্বাসরুদ্ধকরতাকেও বিশদ রকমে জানে! তারা ওই গণ্ডি ও শৃঙ্খল ভাঙতে চায়, খুবই চায়; যদিও তাদের কারোরই উপায়টা জানা নেই! নিরুদ্ধার বেদনার ভারে ধস্ত হয়ে হয়ে, নিরুপায় অভিমান নিয়ে তারা নিজেদের জীবনে মৃত্যু ঘনিয়ে আনে।
রাবেয়া খাতুন বিবাহকে নারী জীবনের পরম পাওয়া বলে গণ্য করেন না, বিবাহ ব্যবস্থাটির স্তব তো করেন না-ই তিনি! বিবাহ, তাঁর কাছে, শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থারই অন্য নাম বলে গণ্য হয়! ‘মধুমতী’ বিবাহিত নারীদের শোচনীয় জীবনের পরিচয়ই বিবৃত করে! লেখক বিশ্বাস করেন, বিবাহ নারীর জীবনকে পঙ্গু করে দেয়, দুর্দশার অতলে নিমজ্জিত করে! বিবাহিত জীবনে অসম্মান ছাড়া নারীর পাওয়ার কিছু নেই। নিঃশব্দে অবিরাম নিজের অসম্মান সহ্য করা, বিবিধ পীড়ন- নিরুপায় হয়ে মেনে নেয়া এবং নিরন্তর খাপ খাওয়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টাই হচ্ছে বিয়ে! এবং ওই সম্পর্কটি ক্রমে শুষে নিতে থাকে নারীর শক্তি ও লাবণ্য। তাই বিয়ে কিছুতেই নারী জীবনের অভীষ্ট হতে পারে না! পুরুষতন্ত্রের এই প্রথাটি- এই যে বিবাহ যার নাম- সেটি নারীর জীবনকে সার্থক করে তোলার সামর্থ্য রাখে না! নারীর জীবন সার্থকতাকে আস্বাদ করবে অন্য পথে!
যদিও মধুমতী উপন্যাসে রাবেয়া খাতুন ওই পথটিকে স্পষ্ট করে নির্দেশ করতে সমর্থ হননি, কেননা, ওই সময়ে তার নিজের কাছেও ওটির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, তবে এই উপন্যাসে তিনি গভীরভাবে বোধ করেছেন যে, নারীকে তার নিজের জন্য নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে একটি পথ!
এই বিরহকাল বস্ত্রবালিকাদের উপাখ্যান। এই উপাখ্যান-নারীর প্রাণান্ত যুদ্ধের গল্প বলে! এই নারীসমাজের নিম্নতলের নারী! তারা সকলেই আত্মনির্ভর, ঘোর পরিশ্রমী। আদতে তারা যোদ্ধা, নিজেকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধরত তারা। তাদের কেউই সেবামগ্ন, ক্রন্দসী, পতি অনুগতা স্ত্রী; বা আত্মোৎসর্গকারী নিঃস্বার্থ জননী নয় ! যদিও তাদের অনেকেই বিবাহিত, কেউ কেউ সন্তানের মাও। কিন্তু পতি ও সন্তানের জন্য নিজের সর্বসুখ বিসর্জন দেয়ার বা নিজের জীবনকে বলি দেয়ার তাগাদা তাদের ছিন্নভিন্ন করে না। তারা স্বামী ও সন্তানের ভালাইয়ের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভালাইয়ের কথাটাও ভাবে। নিজেকে, তারা প্রত্যেকেই, দাঁড় করাতে চায় নিজের মাপের সাফল্যের শীর্ষে। তার জন্য নিজের কর্মে নিজেকে সপে রাখায় তারা অক্লান্ত, অনলস! বিরাম বিশ্রামের পরোয়াহীনও!
স্বামী আর, এই নারীর কাছে,পরম প্রভু নয়! স্বামীর স্বার্থপরতা, দায়িত্বহীনতা এবং খামখেয়ালের পেষণে তার জীবন তছনছ হয়, তবে সে জন্য সে দীর্ঘশ্বাস ও কান্না দিয়ে জীবনকে বিষাক্ত করে তোলে না। সে জেনে গেছে,পুরুষ তার সহায় নয়। মিত্র তো নয়ই। তার সহায় ও মিত্র- সে নিজে। এই নারী পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে গড়া স্নেহ-মমতা ও ত্যাগের প্রতিমূর্তি মাত্র নয়! সে নারী, বিপন্ন কিন্তু লড়াইরত মানুষ! এই নারী-জননী যখন নিজে খেতে পায় না, তখন তার সন্তানও না খেয়ে থাকে। সন্তানের ক্ষুধা মেটানোর জন্য মরিয়া ছুট দেবার তাগাদা তার আসে না! আবার সে নিজে যখন খাবার জোগাড় করতে পারে, তখন সন্তানও খেতে পায়। সে নারী- পুরুষের চেয়েও দায়িত্ববান, পুরুষের চেয়ে মানবিক, পুরুষের চেয়ে সৎ ও পরিশ্রমী! সত্যিকারের মানুষ! তার পাশে ওই তো পুরুষ- অসৎ, ইতর, দুরভিসন্ধিপরায়ণ, অপরিণামদর্শী, অযোগ্য ও দায়িত্বহীন।
পুরুষ তাই কখনোই নারীর শেষ গন্তব্য হতে পারে না। লেখক বিশ্বাস করেন, ‘শুধু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই’ নারীর জীবন সার্থক হতে পারে! কর্মজীবনের সাফল্য ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনই নারীর মুক্তির একমাত্র পথ!
‘মধুমতী’কে তাই গণ্য করা যায় পথ অন্বেষণের উপাখ্যান বলে; আর ‘এই বিরহকাল’ পথ খুঁজে পাবার আখ্যান!