করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





সিডনীর করোনা কড়চা
কাজী এমদাদুল হক










এ তো জানা কথাই, সময় কারো জন্যেই অপেক্ষা করে না। ছুটিতে ছেলেদের কাছে অল্প কিছু দিনের জন্যে বেড়াতে এসে এখন দেখছি মাঝখানে চার-চারটে মাস চলে গেছে। সেই ফেব্রুয়ারিতে এসেছি ছেলেদের কাছে। সিডনিতে দুই ছেলে একসঙ্গেই থাকে। বড় ছেলে বিয়ে করেছে, ওর সন্তান  সাড়ে তিন বছরের। আমরা দাদা-দাদী এসেছি মূলত ওর সান্নিধ্যেই কাটানোর জন্যে। দুই ছেলে, বৌমা আর নাতির সঙ্গে আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনা বেশ আছি। তারপরও মনের একটা অংশ পড়ে আছে দেশেই। সব খবরই পাই প্রতিদিন। এখন চব্বিশ ঘণ্টায় দেশে হাজার হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, নিম্নবিত্ত মানুষের অর্তনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, এইসব তথ্য মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। কবে যে দেশে ফিরতে পারবো, সেটাও নিশ্চিত করে জানি না।
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া কিছুটা ভিন্ন পরিচয় রাখতে পেরেছে করোনা মোকাবেলায়। দেশটি অল্প ক্ষতির ভেতর দিয়ে করোনাকে অনেকটাই পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। চলতি মাসের শুরু থেকেই ব্যবসাবাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। মাসের পর মাস ঘরবন্দী হয়ে থাকা মানুষের সামনে সুযোগ এসেছে সপ্তাহান্তে পরিবারের সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ার। তার মানে এই নয় যে সবাই যেমন ইচ্ছে তেমন চলাফেরা করতে পারছে। সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে মানার নির্দেশ আছে। এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটলেই টহল পুলিশ রীতিমতো জরিমানা করছে নাগরিকদের। তাই সবাই সতর্ক ও সচেতন থাকতে বাধ্য। স্কুল খুলেছে বেশ কিছু, পাশাপাশি অনলাইনে পাঠদানও চলছে। এখন শিশুরাও করোনা ভাইরাসটি সম্পর্কে বহু কিছু জেনে গেছে শিক্ষকদের কাছ থেকে। বলা যায় এ বিষয়েও বিশেষ শিক্ষাদান চলছে। তাই শিশুরাও যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছে। একটি উদাহরণ দিই। আগেই বলেছি আমাদের নাতির বয়স সাড়ে তিন। সে নিয়মিত ডে কেয়ার সেন্টারে যায়। আমরা বাইরে বেরুনোর সময় সে আমাদের সাবধান করে দেয় বাইরে যেন কোনো কিছু স্পর্শ না করি। এমনকি বাসায় ফিরে আসার সময় গাড়িতে ওঠার পর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কথাও সে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এ থেকেই অনুমান করা যায় এই অল্প বয়সেই তাকে সচেতন করে তুলেছেন তার শিক্ষক। এ থেকে সেখানকার শিক্ষার মান সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। এখানে চাইনিজ, লেবানিজ ছাড়াও প্রচুর ভারতীয় ও বাংলাদেশী পরিবারের সন্তানেরা স্কুল-কলেজে পড়ে। আমাদের পরম গৌরবের বিষয় হলো বরাবরই এখানে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে ভালো ফল অর্জন করছে। লক্ষ্য করে দেখেছি কোনো একটা কারণে এখানে লেবানিজরা খুবই অপ্রিয়।
এখানে সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ বিষয়ে কিছু না বললেই নয়। অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তার মোড়ে ‘স্টপ’ লেখা থাকে গোলাকৃতি বোর্ডে। পুলিশ থাকুক না থাকুক ওসব জায়গায় গাড়ি থামানো বাধ্যতামূলক। না থামালে ৩৫০ ডলার জরিমানা করার বিধান রয়েছে। অসাবধানতাবশত আমি সমস্যায় পড়েছিলাম। থামার সংকেত আমি দেখতে পাইনি, তাই গাড়ির গতি কমেনি। গাড়ি যথারীতি এগুতে থাকে। হঠাৎ সাইরেনের শব্দে সচকিত হই। তাকিয়ে দেখি পুলিশ আমাকে গাড়ি থামানোর সংকেত দিচ্ছে। বুঝতে পারলাম না কী ভুল করেছি, তাই কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। রাস্তার পাশে গাড়ি থামালাম। পেছনে পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে এলেন রণসজ্জায় সজ্জিত এক সুদর্শনা। ওই পুলিশ কর্মকর্তা এসে আমার কাছে দাঁড়ালেন। আমি একপলকে দেখে বুঝতে চাইলাম তার ইউনিফর্মে কী কী যন্ত্রপাতি রয়েছে। কোমরে পিস্তল ছাড়াও আছে ওয়াকিটকি সেট, ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করার জন্য বিশেষ যন্ত্র, শ্বাস পরীক্ষা করার জন্য ব্রেথালাইজর (মাদক সেবনকারী চালকদের ধরার জন্য), কোমরে বেল্টের সাথে ঝুলছে হাতকড়া, এবং টর্চলাইট, স্টপওয়াচ ছাড়াও আনুষঙ্গিক যন্ত্র। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম কথাবার্তা রেকর্ড করার জন্য বুকের কাছে সাঁটা রয়েছে ছোট্ট একটা টেপরেকর্ডার। প্রথমেই রূপসী পুলিশ কর্মকর্তার প্রশ্ন: তুমি কী ভুল করেছো? আমি তো জানি না কী ভুল করেছি! তাই সংক্ষেপে বললাম, জানি না। তখন পুলিশটি আমাকে বুঝিয়ে বললেন আমার কী ভুল হয়েছে। আমার লাইসেন্স দেখলেন তিনি, শ্বাসপ্রশ্বাস পরীক্ষা করতেও ভুললেন না। তারপর আমার টেলিফোন নম্বরসহ ঠিকানা লিখে নিলেন। বউমা আমার পাশের সিটেই ছিলেন। তাকেও কিছু রুটিন প্রশ্ন করা হলো। সব মিলিয়ে প্রায় দশ মিনিট লাগলো ধৈর্য্য নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। আমিও তার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিলাম গুছিয়ে। মনে হলো আমার উত্তর তাকে সন্তুষ্ট করলো। সুযোগ বুঝে আমি অনুরোধ করলাম আমার এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য যেন আমাকে জরিমানা না করা হয়। ছোট্ট প্রত্যুত্তর পেলামÑ ‘দেখি, কী করতে পারি’।
সাধারণত দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে জরিমানার কাগজ চলে আসে ঠিকানায়। কিন্তু এরই মধ্যে চার সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও সেই কাগজ এসে পৌঁছোয়নি। একথা বলার উদ্দেশ্য হলো জরিমানা মওকুফের জন্য আমি কোনো অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করিনি, পুলিশকে উৎকোচ দিইনি। সম্ভবত কর্তব্যরত পুলিশ নিজেই অনুধাবন করেছেন যে ভুলটি ছিল আমার অনিচ্ছাকৃত। তাই সেটি ক্ষমার জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে। আমার ধারণা এখানেই আমাদের দেশ এবং একটা উন্নত দেশের মধ্যে পার্থক্য। স্বদেশে ঘুষ সংস্কৃতি বজায় রেখেছে উভয় পক্ষই। তাছাড়া সিস্টেমও অনেক সময় নাগরিককে বাধ্য করে থাকে আইনের পথ এড়িয়ে কার্যসিদ্ধির জন্যে। যাহোক, একটি জাতির সার্বিক উন্নতি তো আপনা থেকে হবে না। এজন্যে প্রত্যেককেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। সাধারণত শৈশব থেকেই শিক্ষাদান খুবই কার্যকরী হয়ে থাকে। ওই যে বলছিলাম এখানে ডে কেয়ার থেকেই একটি শিশু সময়োপযোগী সামাজিক শিক্ষাটা পায়। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি। কথায় কথায় বলি, আমি দেশকে ভালোবাসি। কিন্তু দেশকে ভালোবেসে আমরা দেশের জন্যে কী অবদান রাখি? কতোটুকু আত্মত্যাগ করতে পারি?
এটা সত্যি যে প্রাথমিকভাবে অস্ট্রেলিয়া করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে বড় সাফল্য পেয়েছিলো। কিন্তু ইদানিং আবারও কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এখানকার সরকারও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। এখানকার অনেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। অস্ট্রেলিয়া এখন করোনাজয়ের পাশাপাশি ভাইরাসটির সঙ্গে সহাবস্থান করে তাকে মোকাবেলা করার কৌশল অবলম্বন করেই এগুতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ব্যবসা-বাণিজ্য খুলছে। এখানে আদিবাসীদের সংখ্যা অনেক, তারা প্রায়শই সমাবেশও করে। বিএলএম অর্থাৎ ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মুভমেন্ট বেশ জোরালো। চলতি মাসেই সিডনিতে দশ হাজারেরও বেশি অস্ট্রেলিয়াবাসী এমন সমাবেশে যোগ দিয়েছিল বলে অনলাইন নিউজে পড়েছি। সম্প্রতি আমেরিকায় পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে ওই সমাবেশ হলেও বছর পাঁচেক আগে অস্ট্রেলিয়ায় পুলিশের হেফাজতে নিহত ডেভিড ডুঙ্গয়ে জুনিয়র হত্যার প্রতিবাদও এসঙ্গে যুক্ত হয়। বিক্ষোভের মাত্র ১৫ মিনিট আগে সমাবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় আদালত। কোর্ট অফ অ্যাপিল রায় দেয় যে, এই র‌্যালি আইনত বৈধ। এর মানে হলো, প্রতিবাদকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করতে পারবেন। বড় সমাবেশে অংশ নেওয়ার ফলে কোভিড-১৯ নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের জন্য তারা ফৌজদারি অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন না। যাহোক, এসব সমাবেশের কারণে বড়ো আকারে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই এখানকার সরকার এসব নিয়েও বর্তমানে বেশ উদ্বিগ্ন।

লেখক: বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড) এর মহাপরিচালক