করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





মাকালাত-ই : শামস-ই-তাবরেজি
ভাষান্তর : সাব্বির হাসান নাসির
শৈশব

কোন কোন জ্ঞানীর মতে আত্মা চিরঞ্জীব। কারো মতে, এটা প্রথমে ছিল না, পরে এটা এলো। যাহোক, বেশ কিছুকাল আত্মারা একত্রিত ছিলেন। আত্মারা শ্রেণীবিন্যস্ত সৈনিকদের মতো। যদিও এই একত্রীকরণ অন্য এক জাতের। মদ্যপরা একত্রিত হয়, একত্রিত হয় দুর্নীতিবাজরা। কিন্তু আমি বলছি আত্মার একত্রিত হওয়ার কথা। স্রষ্টার জ্ঞান সবাইকে ঘিরে। আত্মার এই মিলন স্রষ্টার সাথে। নিশ্চয়ই স্রষ্টা তাঁদের সাথে, যাঁরা তাঁকে ভয় করেন (১৬ঃ১২৮)। তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই স্রষ্টা আমাদের সাথে থাকেন’ (৯ঃ৪০)। তাই যদি সৃষ্টির শুরুতে তাতারদের সাথে আমাদের আত্মারা সে একত্রীকরণে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে থাকে, তবে এখনও তারা আমাদের মতোই হবে এবং ইমাদদের মতোও।
স্রষ্টা এই একত্রীকরণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি কাদা পানির প্রতিনিধিকে সৃষ্টিতে নিয়ে আসব এবং আমি তোমাদের বানাব তার সন্তান-সন্ততিরূপে কাদা পানির বিশ্বে।’
তাঁরা বললেন, ‘আমাদের স্রষ্টা, আমরা আপনার সাথে এই একত্রিত বিশ্বে বেশ আছি। আমাদের ভয় হয়, আমরা না আবার পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।’
তিনি বললেন, ‘আমি জানি তোমরা এ শব্দগুলো প্রতিবাদস্বরূপ অসৌজন্যমূলকভাবে বলছ না। তাই, আশ্রয় খোঁজ আমার মাঝে আর একত্ব পৃথকীকৃত হবে বলে ভয় পেও না। তোমাদের জানা উচিত যে আমি শক্তিতে পরিপূর্ণ আদর্শ। আমার শক্তিমত্তায় কোন খুঁত নেই। তোমাদের বেশভূষণ আর পর্দার সাথে আমি তোমাদের একত্রিত করব আর আমি তোমাদের মাঝে দিয়ে দেব মিল আর ঐক্য।’


কাদা পানির পৃথিবীর ছেড়ে, অদেখা ভুবনের পর্বতের পরে আমরা সব মিশেছিলাম একত্রে। ‘নেমে যাও’ এই ডাক শুনে হঠাৎ আমরা সেখান থেকে জেগে উঠলাম (২:৩৮)। অনেক দূর থেকে আমরা দেখলাম, অস্তিত্বের প্রদেশের সীমারেখা। দূর থেকে শহরের বাইরেরটা আর বৃক্ষলতা খুব একটা পরিষ্কার দেখা যায় না। তেমনিভাবে, শৈশবে আমরা এ বিশ্বের কিছুই দেখতে পাইনি। আস্তে আস্তে তা উন্মোচিত হলো। বড়শি আর ফাঁদের ক্ষয়ক্ষতি আসতে আসতে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হল। বড়শির স্বাদ জালের দুঃখকে অতিক্রম করে গেল। তা না হলে অস্তিত্বই যে অসম্ভব হয়ে উঠত।


আমি এ পৃথিবীতে এসেছি চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে। আমি শব্দ শুনেছি শ, ব, দ ছাড়া আর কথা শুনেছি ক, খ, আর আ ছাড়া। এ প্রান্ত থেকে আমি শব্দ শুনছিলাম। কথাকে বলেছি, ‘তুমি যদি কথা হও তবে এগুলো কি?’ সে বলল, ‘আমার জন্য তো ওরা খেলনা।’
আমি বললাম, ‘তাহলে তুমি আমাকে খেলনাদের কাছে পাঠালে?’
সে বলল, ‘না, তুমি এটা চেয়েছ। তুমি কাদা পানির মাঝে ঘর চেয়েছ! আমি তো জানি না। দেখতেও পাই না।
তখন আমি সমস্ত শব্দ শুনলাম, আর সমস্ত কথার স্তরে দেখতে শুরু করলাম।


ছোটবেলায় এক অদ্ভুত ভূত আমায় চেপে বসল। কেউ আমার অবস্থা জানত না। আমার বাবাও না। তিনি বলছিলেন, ‘প্রথমত, তুমি পাগল নও। আমি ঠিক জানি না, তোমার হচ্ছেটা কি। এটা না বেড়ে ওঠা, না নিয়মানুবর্তিতা এবং না...’ আমি বললাম, ‘আমার একটা কথা শোন : আমার আর তোমার অবস্থা সেই মুরগির নিচে হাঁসের ডিমের মতো।
যখন হাঁসের বাচ্চারা একটুখানি বড় হয়, তারা তাদের মায়ের সাথে পানির কিনারে যায়; তারপর পানিতে নেমে যায়। তাদের মা ছিল এক মুরগি। সে পানির চারদিকে দৌড়ে বেড়ায়; পানিতে নামার কোন সম্ভাবনাই তার নেই।
এখন বাবা, আমি দেখি সাগরটি হয়েছে আমার পর্বতের মতন, আর এই আমার ঠিকানা, এই আমার অবস্থা। যদি তুমি আমার হও অথবা আমি তোমার হই, আস এ সাগরে অবগাহন কর। তা যদি না হয়, তবে মুরগিদের মাঝে ফিরে যাও। যেখানে তুমি আটকে আছ।’
তিনি বললেন, ‘তুমি যদি বন্ধুদের সাথে এমন আচরণ কর, শত্রুদের সাথে তুমি তবে কি কর?’


আমি আমার আনুগত্যের কোনো রূপ আমার বাবাকে দেখতে দেইনি। কিভাবে আমি আমার ভেতর আর আমার ভেতরের অবস্থাটা দেখাতে চাইতে পারি? তিনি ছিলেন একজন ভাল মানুষ, আর তাঁর ছিল এক ধরনের মহত্ত্ব। তুমি যদি কিছু কড়া কথা তাঁকে বলে ফেল, অশ্রু তাঁর গাল বেয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু তিনি প্রেমিক ছিলেন না। ভাল মানুষ এক কথা, প্রেমিক অন্য জিনিস।


ভুল আমার বাবা-মার, তাঁরা কী ভীষণ ভালবাসায় আমাকে বড় করে তুললেন। যখন বিড়াল বাটি ভেঙ্গে এক হুলস্থূল কাণ্ড বাঁধাত, আমার বাবা কখনও আমার সামনে তাকে আঘাত করতেন না বা কিছু বলতেন না।
হাসতে হাসতে হয়ত বলতেন, ‘তুমি এবার কি করলে? ভালই। যাক, হয়ত এটাই ছিল পরিণতি, যা এভাবে পেরিয়ে গেল। অন্যথায়, তা আমার, তোমার মার বা তোমার ওপর পড়তে পারত। প্রভু আমাদের দুর্দশায় ফেললেন, কিন্তু তা কেবলই তাঁর করুণায় প্রবাহিত হওয়ার জন্য নিয়ে আসলেন।’


একটা পাগল লোক ছিল। সে অদৃশ্য বিষয়ের কথা বলত। যখনই তারা তাকে ঘরে ধরে রাখতে চাইত, তারা তাকে বাইরে খুঁজে পেত। একদিন আমার বাবা আমার থেকে চোখ সরিয়ে কিছূ মানুষের সাথে কথা বলছিলেন। লোকটি ক্রোধে মুষ্ঠিবদ্ধ করে বাবার দিকে এগিয়ে এলো। সে বলল, ‘এটা যদি এই বাচ্চার জন্য না হতো’, (আমার দিকে ইশারা করে), ‘আমি তোমাকে নিয়ে ওই নদীটাতে ছুড়ে দিয়ে আসতাম।’ এটা ছিল সেই নদী, যা কিনা হাতি টেনে নিয়ে লবণের মরুভূমিতে ফেলে দিয়ে আসত। তারপর সে আমার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘সুখী হও!’ সে কুর্ণিশ করল এবং চলে গেল।
আমি কখনও গুটিতে হারিনি- চেষ্টা করে নয়, স্বভাবগতভাবেই।
আমার হাত কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকত না। যখনই কেউ ধর্ম বিষয়ক আলোচনা করত, আমি সেখানে চলে যেতাম।


আমার ভেতরে এক সুখবর এলো।
আমি অবাক হয়ে যাই ওই সব মানুষদের কথা ভেবে যারা ওই সুখবর ছাড়াই সুখী।
যদি তাদের সোনার মুকুটও এনে দেয়া হয়, তাও তাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না।
আমরা এসব নিয়ে কি করব? আমরা ভেতরে প্রবেশ করতে চাই। আমাদের যা কিছু আছে, সব তারা নিয়ে যাক আর আমাদের আসল জিনিস আমাদের ফিরিয়ে দিক।
যখন আমি এক শিশু, তারা আমায় বলত, ‘তুমি দুঃখী কেন? তোমার কি প্রয়োজন? জামা? টাকা?’
আমি বলতাম, ‘তারা যদি আমার জামা কাপড় সবই নিয়ে গিয়ে আমাকে আমার কাছে দিয়ে যেতে পারত।’


তখনও বেড়ে উঠছি; বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছায়নি। ত্রিশ-চল্লিশ দিন প্রেম আমার খিদে চুরি করে নিয়ে চলে গেল। তারা খাবারের কথা বললে আমি মাথা সরিয়ে ফেলতাম। কি এক সময় ছিল। তারা কত খাবার দিয়ে যেত, আমি তা সব বিনয়ের সাথে গ্রহণ করতাম, কিন্তু আস্তিনে লুকিয়ে ফেলতাম।
 তেমন প্রেমে, প্রেমাস্পদ তাঁর উষ্ণতায় সামার তালে তালে আমায় পাথরের মতো করে ফেললেন। তিনি আমায় একটা ছোট্ট পাখির মতো ঘুরাচ্ছিলেন। এক যুবক, যিনি ত্রিশ দিন উপোসের পর রুটি পেয়েছে, অনেকটা তার মতো করে তিনি আমায় ধরছেন, দ্রুতবেগে ভেঙ্গে ফেলছেন। তাঁর হাতে আমি এক রুটি। আমার দুটো চোখ দুই প্লেট রক্তের মতন। আমি এক কণ্ঠস্বর শুনছিলাম- ‘সে এখনও কাঁচা। কোন এক কোণে ফেলে দাও যাতে সে নিজেকে পোড়াতে পারে।’ আল্লাহ মাফ করবেন, তুমি যদি পান্থশালা থেকে একজন বেশ্যাও তখন ধরে আনতে- আমি তার থেকে অন্তত একশ গুণ দ্রুতবেগে পরম নিপুণতায় নাচছিলাম।
যখন একজন প্রকৃত প্রেমিক নাচতে শুরু করে, তার সাথে নাচে সাত আসমান, পৃথিবী আর সব সৃষ্টিকুল। একজন মোহাম্মদী যদি পুবে নাচতে থাকে, আর পশ্চিমে যদি থাকে আরেকজন মোহাম্মদী সেও একই আনন্দে নাচতে থাকবে।

১০
তিন-চারদিন না খেয়ে থাকতাম- মানুষের কথায় না। কেন ছাড়া কিভাবে ছাড়া ঈশ্বরের কথায়। বাবা বলতেন, ‘হায় আমার ছেলে!’ মা বলতেন, ‘সে কিছুই খাবে না।’ আমি বলতাম, ‘আমি তো আর দুর্বল হচ্ছি না। আমার শক্তি এত যে তোমরা চাইলে আমি জানালা দিয়ে পাখির মতো উড়ে যাব।’ প্রতি চারদিন পর পর, ছোট্ট এক অবসন্নতা আমায় পেয়ে বসবে। অল্প কিছুক্ষণ। তারপর চলে যাবে। এক কামড়ও নিচে যাবে না।
‘তোমার কি হয়েছে?’
‘কিছু না। আমাকে কি পাগল মনে হয়? আমি কি কারও কাপড় ছিঁড়ি?
আমি কি তোমার দিকে লাফ দিয়েছি? আমি কি তোমার কাপড় ছিঁড়েছি?’
‘কিন্তু তুমি তো কিছু খাও না।’
‘আজ নয়।’
‘কাল? আগামী? পরশু?’
ধারে কাছের বাসিন্দা অর্থ কি? আমার বাবা আমার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। আমার শহরে আমি ছিলাম এক অচেনা পথিক। আমার বাবা আমার কাছে এক বিদেশী, আমার হৃদয় তাঁর ব্যাপারে ভীত ছিল। আমি ভাবতাম কখন তিনি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তিনি শান্তভাবে কথা বলতেন আমার সাথে। আমি ভাবতাম তিনি আমাকে মারতে আসবেন; ঘর থেকে বের করে দেবেন। আমি বলতাম, ‘আমার অর্থ যদি তাঁর অর্থ থেকে সৃষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে এটা তারই ফলাফল। এটা তাঁর কাছে তো পরিচিত হওয়া উচিত।’ মুরগির নিচে হাঁসের ডিম।’ তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু।

১১
দেখছিলাম, ঘর আর পুরো শহর তাঁকে ঘিরে ঘুরছে, আর চারদিকের সীমানায় এক আলো, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি উপরে তাকালাম, ছাদ দেখতে পেলাম না। এ অবস্থায়, আমার বাবা বললেন, ‘ও আমার বাবা।’ দুই ধারা জল আর রক্ত তাঁর দু’ চোখ বেয়ে নেমে আসল। এ সময় কিছু একটা বলতে চাইলেন। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। জ্বর অনেক বেড়ে গেল। তখন তিনি চলে গেলেন।

(চলবে)
(প্রাসঙ্গিক কথা: সুফি দর্শনের দুই কালজয়ী ব্যক্তিত্ব জালালুদ্দিন রুমি ও শামস-ই-তাবরিজির ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত রয়েছে। দুটি সত্তার জাগতিক সম্পর্ক এক পর্যায়ে জগতের জন্য এক পরম আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উৎসারণ ঘটায়। আটশ বছর ধরে সেই জ্ঞানের বিভায় আলোকিত হয়ে চলেছে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার সব জাতির সত্যসন্ধানী মানব-হৃদয়। রুমি-শামসের আলাপচারিতায় জীবন ও জগতের রহস্যময়তা ও পরমার্থ প্রকাশের ইঙ্গিত কালে-কালে ভাবুকদের আপ্লুত ও আন্দোলিত করেছে। বাংলায় এই কথোপকথনের ভাবরস তাৎপর্যপূর্ণভাবে উপস্থাপনের সুযোগটিকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন গ্রন্থকার সাব্বির হাসান নাসির। এ কাজের জন্য গদ্য কবিতার আঙ্গিক তিনি নির্বাচন করেছেন সত্যের শাঁস তুলে ধরার উপায় হিসেবে। এতে কোনো সংশয় নেই যে, এই গ্রন্থ পাঠ করতে করতে পাঠক ভাবসমুদ্রে অবগাহনের সুখ, তৃপ্তি ও আনন্দ লাভ করবেন। তাঁর সামনে খুলে যাবে সম্পূর্ণ অজানা একটি পথ; হৃদয় শোনাবে : এই পথেরই তো সন্ধান করে চলেছিলাম এতটা বছর!
শামস-ই-তাবরিজির বয়ান, আলাপ ও দর্শন অনুধাবনের জন্য সততা, দার্শনিক মন জরুরি; প্রজ্ঞা আর মেধা পূর্বশর্ত। সেইসঙ্গে ওই পরম সত্যস্বর এবং গভীর জ্ঞান একটি ভাষার সীমানায় উৎকীর্ণ ও পরিকীর্ণ করবার জন্য কবির মননও অত্যাবশ্যক। রুমির মতো বিশ্বজনীন কবিকে যিনি উদ্দীপিত ও প্রভাবিত করেছেন সেই সন্ত বা দরবেশ শামসের বাক্যের বাঁকে যে ইশারার ঝিলিক, যে দৃশ্য-সুষমা- তা অক্ষরের কক্ষপথে প্রোথিত করার কাজটি যিনি করবেন তাঁকে কবি ও দার্শনিক হতেই হবে- এ ব্যাপারে কে করবেন দ্বিমত পোষণ! সুফি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ এবং রুমির রচনায় ভক্তি সবার থাকে না। এ এক ভিন্ন আধ্যাত্মিক পথরেখা, যিনি সে রেখার বিদ্যুতে একবার ঝলসিত ঝলকিত হয়েছেন, কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব ধারাবাহিক পদক্ষেেেপ সেই সত্যসুরায় সন্তরণ ও নিমজ্জন। অনুবাদককে তাই শুধু সাধুবাদ নয়, কৃতজ্ঞতা জানানো সমীচীন।
আরবি ফার্সিতে রচিত সুফিসাহিত্যের বাংলা ভাষান্তরে সফলতা পেয়েছেন কেউ কেউ। রুমি-হাফিজের কাব্যরস পান করে মাতাল হয়েছেন ক-জন কবি এবং কবিতার অনুবাদক। কিন্তু শামস-ই-তাবরিজির মতো সুরসিক দরবেশের বাণী বাংলা ভাষায় সার্থকভাবে উপস্থাপনের কৃতিত্ব বেশিজনের নেই। আমাদের, সুফিসাহিত্যের অনুরাগী পাঠকদের, সৌভাগ্য যে সাব্বির হাসান নাসিরের মতো একনিষ্ঠ অনুসন্ধানী সাধক তরুণ বয়স থেকেই সুফিসাহিত্যের সাগরে ডিঙি ভাসিয়েছেন। তাঁর অবলম্বন প্রধানত সুফিসাহিত্যের ইংরেজি ভার্সন। অবশ্য ইংরেজি ভাষায় সুফিসাহিত্যের ভা-ার গড়ে তোলার কাজ করেছেন অনেক লেখক। কিন্তু সাব্বির এদের মাঝ থেকে নির্বাচন করেছেন সুনির্দিষ্ট তিনজনকে। দুই মার্কিনী উইলিয়াম সি চিত্তিক এবং ক্যামিলে অ্যাডামস হেলমিনস্কি রুমি ও শামসকে নিয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। দ্বিতীয়জন তাঁর স্বামীর সুফিসাহিত্যের ফাউন্ডেশনে নিরলস ভূমিকা রেখে চলেছেন। নারী সুফিদের তত্ত্বতালাশের কাজে তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। আর তুর্কি লেখক রেফিক অ্যালগান সুফিসাহিত্যের অনুবাদে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। এই তিনজনই আধুনিককালের লেখক। আটশ বছর আগেকার সুফিসাহিত্যের প্রতি, বিশেষ করে শামস-ই-তাবরিজির প্রতি বিশেষ পক্ষপাত রয়েছে তাদের। সাব্বির এই তিনজনেরই শামস সংক্রান্ত যাবতীয় গ্রন্থ পাঠ করেছেন, যদিও ভাষান্তরের জন্য নির্বাচন করেছেন বিশেষ দুটি গ্রন্থ। অর্থাৎ সেরা রসটুকু বাঙালি পাঠকের সমীপে পরিবেশনের জন্যই তিনি গ্রন্থ দুটি নির্বাচন করেছেন। তাঁকে শুদ্ধতর সুফিগবেষক হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে না। যদিও একইসঙ্গে আমাদের এটা স্মরণে রাখতে হবে যে সাব্বির আক্ষরিক অনুবাদক নন, তিনি ভবের হাটে ভাবের মাতাল। শামস-ই-তাবরিজির গূঢ় ও প্রগাঢ় বক্তব্য বাংলায় পরিবেশনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে তাঁর অবস্থান ছিল ‘মুক্ত’। ‘স্বাধীন’ শব্দটি অনেকবার স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হতে দেখেছি আমরা, তাই ‘মুক্ত’ শব্দটি প্রয়োগ করা হলো সচেতনভাবে। - মারুফ রায়হান ২০১৮)