গত চারমাসে কত কিছুই না ঘটে গেল। টরোন্টোর রাস্তার গুঁড়ো গুঁড়ো বরফেরা সব জমে জমে প্রথমে শক্ত বরফখন্ড হয়ে গেল; তারপর প্রস্তরখন্ডের মতো শক্ত কিন্তু চকচকে সেই বরফ আবার ধীরে ধীরে গলেও গেল সময়ের পরিক্রমায়। তারপর আবার কাউকে অবাক না করেই তুষারপাত শুরু হলো, আবার বরফ, আবার ভেজা ভেজা রাস্তা, মাঝে মাঝে রোদ, উজ্জ্বল রোদ্দুর পেরিয়ে এখন বেশ নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে অদ্ভুত এই শহরে! জিজ্ঞেস করতে পারেন, শহরটাকে অদ্ভুত কেন বললাম? আচ্ছা বলবোই না বা কেন? পৃথিবীর কোন শহরটা অদ্ভুত না আমাকে বলতে পারেন? প্রতিটি শহরের আলাদা একটা গন্ধ থাকে, একটা রঙ; এই রঙ এবং গন্ধ অবশ্য শুধুমাত্র ঈশ্বরের তুলিতেই ধরা পড়ে। বড় বড় শিল্পীরা কদাচিৎ তা তুলির আঁচড়ে কাগজে অথবা চলচ্চিত্রের রূপে তুলে ধরতে পারেন বৈকি কিন্তু তাতে এই আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর রাখার নেয়ার আগ্রহে ভাটা পড়ে না!
যাই হোক, যা বলছিলাম! আমি তো অমন ভাগ্যবান কেউ নই, ঈশ্বরের বরপুত্র হওয়া হয়নি আমার! তাই পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত বরফে ডুবিয়ে হেঁটে হেঁটে যে যাত্রার শুরু, বৃষ্টিতে আসাতেও তাতে তেমন কোন হেরফের হয়নি। তাপমাত্রা শূন্যের উপর উঠে আসায় শুধু ঘাড়ের ব্যথাটা খানিক কমে এসেছে, কারণ কেজিখানেক ওজনের ওই ওজনদার জ্যাকেটটা আর ইদানীং চড়াতে হচ্ছে না আমার অল্প-প্রশ্বস্ত ঘাড়ের ওপর! মাঝে কদিন বেশ উষ্ণ ছিল শহরটা। তাপমাত্রা উঠেছিল এমনকি ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর। টরোন্টোবাসি মনের আনন্দে কাপড়ের বাহুল্য ত্যাগ করে রাস্তায় নেমে পড়েছিল ঝা-চক-চকে রূপ নিয়ে। আমি ভেতো বাঙালীও বেশ সাহস করে কদিন খুবসে দৌঁড় ঝাপ করলাম কুইন্স পার্ককে ঘিরে। সেদিন এক কবিতাপ্রেমী বন্ধু বলল, বয়স বাড়তে বাড়তে আবার পেটুল হয়ে যেও না। আমি মনকে বললাম, জো হুকুম! প্রতিদিন ঘন্টাখানেক দৌড় দিই এদিক সেদিক, উদ্দেশ্যহীনভাবে।
কতকিছুই না চোখে পড়ে এই শহরে! স্ট্রলারে করে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাওয়া শিশু, অল্প বয়স্ক উচ্ছল তরুণতরুণী, শনিবার গভীর রাতের ট্রেনে গভীর আবেশে চুম্বনরত প্রেমিক-প্রেমিকা, শুক্রবারের মদ্যপ তারুণ্য, আর বৃদ্ধ মানুষ – অনেক অনেক। অতি ধীরে শহরের রাস্তাগুলোয় তারা একাকি হেঁটে চলেন বেশিরভাগ সময়। আমি বার্ধক্যের সাথে কেন যেন সময়কে মিলিয়ে ফেলি। অথবা ধরুন, বিমানবন্দরের ট্রানজিটে যেসব চলমান পথ থাকে, সেসবের সাথে। মনে করুন চলমান সব সিড়ি, ওই যে একবার উঠে দাঁড়ালেন, তারপর ঠিকই গন্তব্যে নিয়ে ফেলল – অনেকটা তেমন! যতক্ষণ ওই সিঁড়িতে দাঁড়ানো থাকি, জানি সবাই যাচ্ছি শেষ মাথায়, তারপর যে যার রাস্তায় – গন্তব্য, জানা নেই।
সপ্তাহখানেক আগে বিশ্বতরঙ্গ (ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব) ঘেঁটে জানতে পারলাম, টরোন্টোর কিছু পাবলিক লাইব্রেরিতে নাকি বাংলা বই পাওয়া যায়! সবচেয়ে বড় পাবলিক লাইব্রেরি আমার অস্থায়ী নিবাস থেকে হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। বিবি-বাচ্চাকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম ঝটপট। লাইব্রেরিয়ান অমায়িক ভদ্রমহিলা, যতটুকু জানতে চাই, তার চাইতেও ঢের বেশী সাহায্য করতে চান। কম্পিউটারে ঢুকে, নানাকিছু ঘেটেঘুটে বললেন, “আমাদের বাংলা বইয়ের সংগ্রহ মাঝারি। তোমার পছন্দ হবে কিনা জানি না। তবে আমাদের সংগ্রহই এখানে সবচেয়ে ভালো, অন্য আরও কিছু লাইব্রেরিতে আরও কিছু বই পাবে, কিন্তু সংখ্যায় আমাদের চাইতে বেশী নয়।” আমি ভদ্রমহিলাকে শুকরিয়া জানিয়ে লাইব্রেরির নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছে যাই। মুগ্ধ হয়ে দেখি প্রায় হাজারখানেক বাংলা বই। মহিলাকে বলা হয়নি, আমার একটা বাংলা বই হলেই চলত, আমি তো আর পড়তে আসিনি, জীবনে বহু বাংলা বই পড়েছি, তার মানে এই নয় যে আর পড়তে নেই, কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য তো বইয়ের মলাট উল্টে বাংলা বর্ণমালায় হাত বুলোনো!
শেষ যে চিঠিটা লিখলাম আপনাদের মাস চারেক আগে, তারপর এখানে খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদযাপন হয়েছে খুব সাদামাটাভাবে। ঠিক মধ্যরাতে পাঁচ মিনিটের আতশবাজি হলো ন্যাথান ফিলিপস স্কয়ারে। প্রচন্ড ঠান্ডা ছিল সে রাতে, যাকে বলে হাঁড়-কাপানো শীত। সবাই দশটা থেকেই জড়ো হয়েছিল। তারপর পাঁচ মিনিটের আতশবাজি শেষে যে যার পথে। প্রচন্ড ভিড়। লক্ষাধিক মানুষ হয়েছিল পড়েছি পত্রিকায়, অনেকটা আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি বইমেলার সন্ধ্যাবেলার মতো। আধ-কিলোমিটার পথ পার হতেই সময় লেগেছে প্রায় ৪০ মিনিট! আসলে নববর্ষের প্রাক্কালে কানাডাবাসির বার্ষিক ছুটি শুরু হয়ে যায় যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষ্যে, আর তাই আমাদের মতো না-ঘরকা, না-ঘাটকা ঘরানার মানুষেরাই মূলত এই সময়ে টরোন্টো থাকেন, বাকিরা চলে যান যার যার শেকড়ে, বলতে পারেন গ্রামের বাড়িতে!
জানুয়ারি থেকে এপ্রিল, শিক্ষার্থীদের জন্য বিভীষিকাময় সময়। তারমধ্যে যারা আমার মতো বুড়ো এবং গ্রাজুয়েট স্কুলের ছাত্র, তাদের দুর্দশার সীমা নেই! নতুন পরিবেশ, নতুন করে পড়ালেখা, হাড়-মজ্জায় ঢুকতে চায় না! এই ভয়ংকর দুর্যোগের মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি আর ১ বৈশাখ গেল। একুশে ফেব্রুয়ারির রাতে সপরিবারে ঘুরে এসেছিলাম বাংলা পাড়ায়। ওখানে যেয়ে জানলাম সব অনুষ্ঠান দুটি ভাগে বিভক্ত, রাজনৈতিক বিভাজন! ১ বৈশাখে অবশ্য বেশ হৈ-হুল্লোড় হয়েছে, তবে আমার কেন জানি যেতে ইচ্ছে হয়নি। আমি ঘুরে এসেছি আগের রাতে। আলপনা আঁকা চলছে, মুখোশ বানানো, তবে তার চাইতেও ভালো লেগেছে বাংলা পাড়ার ফুটপাতে, রাস্তায় শত শত বাঙালীর মিলনমেলা দেখে। দেখলে মনে হবে সাতাশ রোযা শেষের বেইলি রোডের রাস্তা, হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-উৎসব; যদিও ভিড় তুলনামূলকভাবে বেশ কম। এরমধ্যে কয়েকদিন আগে একটা ছোটখাট বিশৃঙ্খলা হয়ে গেল। টরোন্টোর একটি বাংলা টিভি চ্যানেল সমস্ত বাঙালিকে মেজবান খাবার দাওয়াত দেয়। প্রথমে বলা হয় ২০ হাজার মানুষের দাওয়াত, তারপর অনলাইনে ২৭০০ মানুষ যাবে জানান দেবার পর বলে দেয়া হয় এর বেশী মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব নয়, তথাস্তু! অনুষ্ঠানের দিন শত শত বাঙালি উপস্থিত হয় মিলনমেলায়, কিন্তু প্রথম ব্যাচের শ’তিনেক মানুষকে খাওয়ানোর পর শুরু হয় খাবারে টানাটানি। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে বাঙালীরা হতাশ হয়ে ঘরে ফেরেন। পরে কেউ কেউ ঘন্টা তিনেক অপেক্ষা করে মেজবান খেতে পেরেছিলেন শুনেছি, কিন্তু তাতে করে ফিরে যাওয়া নাখোশ বাঙালীদের উষ্মা আর কমেনি!
সে যাই হোক, এমন ঘটনা রোজকার ব্যাপার – সে টরোন্টোই বলুন, কিংবা ঢাকা অথবা কলকাতায়! এদিকে প্রিয় মানুষ, সাহিত্যিক মাসউদুল হকের দীর্ঘশ্বাসেরা নাকি আসলেই হাওরের জলে ভাসছে? কাঁদছে আমার প্রাণপ্রিয় বানভাসি মানুষেরা! কষ্ট হয়, দীর্ঘশ্বাস পড়ে। এদিকে দেশের সাথে সহানুভূতি জানাতেই নাকি টরোন্টোতে বন্যার সতর্কতা জারি হয়েছে। লেক অন্টারিওর পানি ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশী উথলে উঠেছে, যেকোন সময় পুরো শহরে ঢুকে যাবে! আমার আম্মা দেশ থেকে উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চান, সাবওয়ে তো মাটির নিচে, পানি যদি সাবওয়েতে ঢুকে যায়, তাহলে প্রিয় ছেলের কী হবে! দেশে দুটো গাড়ি চালানো ছেলের এখন বিদেশের মাটিতে পদব্রজে বিদ্বান হবার চেষ্টা যদি সাবওয়ের জলে ভেসে যায়, তাহলে চিন্তার বিষয়ই বটে! যদিও এখানকার মানুষ এসব বিষয়ে অতটা উচ্চকিত নয়। তিন স্টেশন পর পানি উঠলেও কেউ খবর নেয় না তেমন, হয়ত নিজের স্টেশনে জলের ধাক্কা শব্দের স্রোত হয়ে কানে বাজলে তারপর নড়েচড়ে উঠবে! অপেক্ষায় আছি কী হয় দেখবার জন্য।
কথায় কথায় বলতে ভুলে গেছি, মার্চের শেষে কদিনের জন্য গিয়েছিলাম মার্কিন মুলুকের এক আপাত অজানা তল্লাট আটলান্টায়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের জন্য এ এক অতি পরিচিত তীর্থস্থান! বিশ্বসেরা এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, রোগতত্বের সরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল, জনপ্রিয় পানীয় কোকা-কোলা, বিতর্কিত সংবাদ মাধ্যম সি এন এনের ঘর দুয়ার এই আটলান্টায় অবস্থিত। আমি গিয়েছিলাম একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। প্রতিযোগিতা শেষে একদিনের জন্য সুযোগ পাই শহরটা ঘুরে দেখতে। যতই বাঙ্গাল বলে গালি দেন না কেন ভাই, দুনিয়া ঘুরতে গেলে বাঙালীর বিকল্প নেই। নাহলে পাভেল ভাইকে কোত্থেকে এই অচেনা শহরে ঠিকই পেয়ে যাব আর উনিও তার ব্যস্ত ছুটির দিন থেকে আধবেলা আমাকে দিয়ে দেবেন ঘুরিয়ে দেখাবার জন্য। ঢাকা ছাড়ার পর অসাধারণ আধবেলা কাটল পাভেল ভাইর সাথে আটলান্টার এদিক সেদিক ঘুরে। দুপুরে খাবার জুটল আরেক বাংলা রেস্তোরায়! রেস্তোরার মালিক গল্পে-সল্পে আমার বিয়ের জন্য যখন তার পতœীর এক আত্মীয়-কন্যার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়ে দিচ্ছেন প্রায়, তখনই অনিচ্ছাসত্বেও জানাতে হলো আমার নিজের কন্যার বয়স সাড়ে নয় বছর হতে চলল!
এদিকে গত সপ্তাহে যে পুরো টরোন্টো শহর চেরি ফুলে ভরে গেল বলিনি আপনাদের? সাধারণত চেরি ব্লোসোম উৎসব হয় বছরের এই সময়টাতে। দলে দলে মানুষ ছুটে যায় হাই পার্কে ফুল দেখতে, ছবি তুলতে; তবে এবছর এর স্থায়িত্ব ছিল বোধহয় সবচেয়ে কম। ক্রমাগত মেঘের নিরব গর্জন আর মেঘলা আকাশের সরব ক্রন্দনে চেরিরা ঝরে গেছে অকাতরে, প্রেমে পড়বার সুযোগ দেয়নি তেমন। একদিন অলস বিকেলে সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে পার হচ্ছিলাম রবার্টস লাইব্রেরি। অযাচিত ভিড়, অর্থাৎ প্রায় জনা পঞ্চাশেক মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেন লাইব্রেরির পাশে, অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এক অনাবিষ্কৃত চেরি ঝোপ! বেশ কয়েক স্টেশন পেরিয়ে যেখানে সপ্তাহখানেক ধরে হাই পার্কে চেরি ফুল দেখতে যাব ভাবছিলাম, ঠিক তখনই বলতে গেলে ঘরের দুয়ারে এই মনোমুগ্ধকর চেরি ঝোপ আবিষ্কার করে আমি হতবাক প্রায়। জানতে পারলাম অনেক বছর আগে ৭০টি চেরি চারা এনে লাগানো হয়েছিল ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোর এই বিশাল লাইব্রেরির পাশে, সেই চারাগাছ আস্তে আস্তে বড় হয়েছে, এখন প্রতিবছর এখানেই বলতে গেলে একটা ছোটখাট মেলা বসে যায়। দর্শনার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই কোরিয়া-জাপানের শিক্ষার্থীরা। তারা বেশ আয়োজন করে এখানে ফটো সেশন করে। আমরাও আর বাদ যাই কেন? মোবাইল বের করে ঝটপট তুলে ফেলি বেশ কিছু ছবি, আসলেই মনোমুগ্ধকর এই চেরির ঝোপ – মন কেড়ে নেয় অদ্ভুত ভালোলাগায়।
আগামী কিছুদিনে বৃষ্টি হয়ত ধরে আসবে। বসন্ত বাতাসে প্রেমের আভাস। নানারঙের ফুল ফুটবে বাগানে-উদ্যানে! বসন্তের এই কয়দিন নাকি সামারের আগে এক প্রাণবন্ত জীবনধারার লক্ষণ। এই কমাসকে হৃদয়ে ধারণ করে কানাডার মানুষ কাটিয়ে দেন বছরের বাকি দিনগুলো বরফের চাদরে। এখন সন্ধ্যা বাইরে। মেঘলা আকাশ। সূর্য দেখা যাচ্ছে না কদিন ধরে, তাতে আমার তেমন আপত্তি নেই। এই মেঘ বৃষ্টির মাঝেই লুকিয়ে আছে আমার বাড়ন্ত কৈশোর, ফুটন্ত যৌবন। আকাশের রঙ যেমনই হোক না কেন, মনের রঙে তুলির ছোঁয়া দিতে পারে এমন কেউ কোথাও আছে কি? দেখা যাক এই বসন্তে। এই বরষায়। টরোন্টো থেকে ভালোবাসার চিঠি পাঠিয়ে দিলাম প্রিয় শহরে...
৭ মে, ২০১৭
ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো
টরোন্টো, কানাডা