করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





টরোন্টোর চিঠি
শামীম আহমেদ
মানুষের সাথে কত কিছুরই না তুলনা হয়Ñ যেমন বৃক্ষের! একটি শিশু যখন ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, তখন তার সাথে শীতের শেষে জেগে ওঠা নতুন বৃক্ষপল্লবের তুলনা হয়। দৃঢ়চেতা কোন মানুষ বোঝাতে তুলনা করা হয় বটবৃক্ষের সাথে। তেমনি সুন্দরী নারী, নির্ভার শিশু, একহারা পুরুষ, নানা মানুষের সাথে নানা বৃক্ষের তুলনা আমরা দেখে এসেছি যুগ যুগ ধরে। আমার কাছে মনে হয় বৃক্ষ আর মানুষের সবচেয়ে বড় মিল আসলে শেকড়ে। বৃক্ষের শেকড় প্রোথিত থাকে মাটির গভীরে। মানুষেরও শেকড় আছে, আমরা দেখি না হয়ত, তবে কেউ কেউ অবশ্যই অনুধাবন করি, ভাবনার ডানাগুলোকে মেলবার প্রয়াস দেই।

“গাছের মৃত গুঁড়ির মতো অখণ্ড পড়ে আছে এক জোড়া ঘুণে ধরা স্বপ্ন। অস্থিরতা এখানে শেকড় গেড়েছিল একদিন, বহুদিন আগে স্বপ্নের ভেতর। শেকড় মরে গ্যাছে, মাটির প্রোথিত অবিশ্বাস থেকে উঠিয়ে নিয়েছে জীবন। যদিও জানে না নিশ্চিত, তবু স্বপ্নরা ভাবে ডানা মেলেছে ঠিকঠাক জীবনকে ছাড়িয়ে। আসলে অখণ্ড মৃত গাছের গুঁড়ির মতো স্বপ্নরা পড়ে থাকে ছিঁড়ে যাওয়া শেকড়কে ঘিরে। বিশ্বাস ডানা মেলে উড়ে যায়, পড়ে থাকে অবিশ্বাস মৃত কিছু জীবনের ঘ্রাণ বুকে নিয়ে।“ (ঘুণে ধরা স্বপ্ন; প্রিয় প্রেম অপ্রিয় বিচ্ছেদ)
 
ইদানীং টরোন্টোর মন ভালো যাচ্ছে না। বর্নিল মেপল পাতাগুলো রঙ হারিয়েছে, গাছগুলো সব বিরহী আত্মার মতো ভিজে ভিজে যাচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফে। ডিসেম্বর মাসে নাকি সাধারণত এত তুষারপাত হয় না এই অঞ্চলে। এবার তাহলে কী হলো! তবে এই তুষারপাত যে নিয়মিত তাও নয়। গত সপ্তাহে খুব একচোট নিল বোধহয় নতুন আসা বাঙালীদের স্বাগতম জানাতে, প্রচন্ড হাড় কাঁপানো দশমিকের নীচে ঠান্ডা তাপমাত্রা, তার ওপর আবার তুষারপাত হচ্ছে তো হচ্ছেই। এ সপ্তাহে বরঞ্চ কিছুটা ভালো। তাপমাত্রা শূন্যের নীচে দশ পর্যন্ত চলে গেলেও বাতাসের তীব্রতা কিছুটা কম, সূয্যি মামাও বেশ দেখা-টেখা দিচ্ছেন!
তবে স্থানীয়রা হেসে ওঠে ঠান্ডার কথা শুনলে। বলছে এ তো বেশ নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া হে! কুসুম-কুসুম তুষারপাতে ছুটির দিনে বের হয়ে পড়ো পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাথে। শুধু চলমান পথে জমে যাওয়া স্বচ্ছ ব্ল্যাক আইসের দিকে নজর রেখো, ওগুলো মাড়াতে যেও না খবরদার, তাহলে নিশ্চিত চিৎপটাং হয়ে পড়তে পারো টরোন্টোর ভেজা ভেজা কান্নাময় রাস্তাগুলোয়। আচ্ছা বরফগুলো যদি স্বচ্ছই হবে, তবে তোমরা ওগুলোকে ব্ল্যাক আইস বলছ কেন? আরে বাবা বোঝো না কেন? আমাদের ফুটপাথগুলো তো এমনিতেই ধূসর। শীতের সময় বরফে ভিজে ওগুলো কালো হয়ে যায়, তুষারপাত শেষ হলে যখন ওপরের হালকা তুষার গলে ধুয়ে হারিয়ে যায় মাটির তলায় তখন পড়ে থাকে স্বচ্ছ ওই গা কামড়ে পড়ে থাকা পাতলা বরফের আস্তর, দেখলেও দেখা যায় না, চিনলেও চেনা যায় না ওদের, তাই একটু অন্যমনস্ক হলেই পা পিছলে আলুর দম। একদম নিজের দেশের শীতের কথা মনে করিয়ে দেবে কিন্তু বাপু!
ঢাকার শীতের কথা মনে পড়লেই মনটাকে আর বেঁধে রাখা যায় না। ওই যে বলছিলাম শেকড়ের কথা, বৃক্ষের শেকড় প্রোথিত থাকে মাটির গভীরে, আর মানুষের শেকড়? দেখা যায় না অথচ তবু দেখ মাটি বরফ সব খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঠিক পৌঁছে যায় যেখানে যাবার সেখানে! হাতিরঝিলে নাকি ওয়াটার কার চালু হয়েছে। হরেক মানুষ নানা রঙের মাফলার গলায় জড়িয়ে বেশ ছুটে চলেছে গন্তব্যে অথবা অগস্ত্যযাত্রায় – ঢাকার শীতই এমন, কেমন যেন দিশেহারা – কে কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে ঠিক ঠাহর করা যায় না! নিকেতনের নিওন সাইনের মাথাও ওলট-পালট থাকে এইসময়টায়- ‘নি’ হারিয়ে যায় বিশাল প্রবেশ মুখের মাথা থেকে, ‘কেতন’টুকু আলো ছড়ায় বুঝি গুলশানের কেতন হয়ে! তেজগাঁও লিংক রোড হয়ে পিকাসো রেস্তোরার উল্টোদিকের ৩ নম্বর গেটের মুখে অথবা শুটিং কমপ্লেক্সের উল্টো দিক দিয়ে ঢুকলে গুলশান সাউথ পার্কের পাশে লেকের ধারে বসে জমজমাট ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা বিক্রির উৎসব! নানারকম ভর্তা দিয়ে পিঠা কিনতে শহুরে ঢাকাবাসী ভিড় করতে থাকেন সন্ধ্যা হওয়া শুরু হলেই, বয়স্ক নিকেতনবাসীরা মাফলারটা বেশ করে গলায় জড়িয়ে নেমে যান পার্কের পথে, দৈনন্দিনকার বেঁচে থাকার যুদ্ধে- শরীরটা তো ফিট রাখতে হবে বাহে!
টরোন্টোর প্রাণকেন্দ্র মানেই ডাউনটাউন। হিসেব মতে আমাদের জিরো পয়েন্ট হবার কথা যদিও, তা আর হয়ে ওঠে না, তুলনা করা যায় ওই গুলশান ১ এর সাথেই। নানারকম খাবার দোকান, টাকা ধার দেবার দোকান, পোষাকের দোকানের সাথে সাথে সুউচ্চ সব অট্টালিকা, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, নামকরা সব ব্র্যান্ডের দোকান নিয়ে সাজানো বড় বড় মার্কেট, সিনেমা হল আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা! এখানে বাস করা বেশ কঠিন, সবকিছুর দাম বেশী, পার্কিং নেই বললেই চলে; এর ওপর আবার আপনি দেশ থেকে আসার সময় আগ থেকে সতর্ক করে বলা হবে খবরদার এখানে কিন্তু বেশ শব্দ-টব্দ হয়, নতুন নতুন ভবন হচ্ছে, গাড়ি আর মানুষের ভিড়ে পরে আবার বিরক্ত হতে পারবে না! আমরা বাঙালীরা হেসেই খুন। এই তোদের গাড়ি-বাড়ি-মানুষের ভিড়! কোরবানীর ঈদের দ্বিতীয় দিনের ঢাকায় এর চাইতে হাজার গুণ বেশী ভিড় থাকে। দেখে আসিস! আমার এগার তলার এপার্টমেন্ট থেকে রাস্তাগুলো লোকশূন্যই মনে হয়। প্রায়ই মনে হয় এ শহরে শুধু আলোকবাতি থাকে। নানা রকমের আলো। সবুজ-হলুদ-লাল। দেয়ালে, মেঝেতে, রাস্তায় – আলো আর ধোঁয়া। মানুষগুলোও মন্দ নয়।
ডাউনটাউন টরোন্টোতে যেন প্রাণের মেলা। ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোর খুব কাছে হওয়াতে এখানে নানা দেশের নানামুখ দেখতে পাওয়া যায় চলতে ফিরতে। তারুণ্যের প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর। হন হন করে হেঁটে যেতে থাকা মানুষগুলোকে দেখা যায় সকাল সন্ধ্যা। ব্লুর-ইয়ং ক্রসিং ধরে হেঁটে অথবা সাবওয়ে ধরে ছুটে যাচ্ছে দূর-দূরান্তরে।
তো যেমন বলছিলাম, এই শীত স্থানীয়দের কাছে রোদ পোহানোর মতোই। ক্রিসমাস আর বছরে শেষ দিন কাটিয়ে যে হাড় কাঁপানো শীত আসি আসি করছে তার ওমটাই তারা যেন একটু গায়ে লাগিয়ে নেয় ডিসেম্বর মাসটাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সময় প্রতিদিন পার হতে হয় কুইন্স পার্ক। অদ্ভুত সুন্দর সাদায় ঢেকে থাকে বিশাল চত্বর। তার মাঝে অসংখ্য গাছ আর ছোট ছোট স্থাপত্য, কাঠবিড়ালির দল দৌড়ে বেড়ায় গাছ থেকে মাটিতে, মাটি থেকে গাছে। রোমশ আর গাঢ় ধূসর অথবা কালো ওদের গায়ের রঙ। তাদের বাদাম খাওয়ায় পথিকেরা। এছাড়াও আছে হাজার হাজার কবুতর আর চড়ুই। চামড়ার নীচে মোটা চর্বির পরত বাঁচিয়ে দেয় তাদের এই হিমশীতল পরিবেশে। যখন বরফের মেঘ কাটিয়ে উঁকি দেয় সূর্য, তখন ঝাঁক বেঁধে ডানা মেলে কবুতরের দল। আমাদের জালালি কবুতরের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই শীতে বেশীক্ষণ খোলা জায়গায় থাকা যায় না। ক্লান্ত হবার আগেই দল বেঁধে ঢুকে পড়া টিম হর্টনের কফি শপে। এখানের মানুষ খুব পছন্দ করে ‘ডাবল ডাবল’ নামের একটা কফি। দুধ আর চিনি দুটোই ডাবল করে দেয়া হয় বলে এর নাম হয়েছে ডাবল ডাবল। সাথে চকোলেট ডিপ ডোনাট নিয়ে বসে পড়ে আড্ডায়। তুরস্কে রাশিয়ান এম্বাসেডরকে গুলি করা বিদ্রোহি তার্কিশ পুলিশ অফিসার কিংবা বার্লিনের ক্রিসমাস মার্কেটে ট্রাক নিয়ে ঢুকে পড়ে বারজন মানুষের অকাল মৃত্যু, যুরিখের মসজিদে হামলায় আহত মুসল্লী শুধু টরোন্টোপ্রবাসী বাঙালীদেরই নয় কসমোপলিটন এই শহরের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নানা দেশের পি এইচ ডি গবেষকদের আড্ডার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়! ‘টরোন্টো স্টার’ পত্রিকার অনলাইন শিরোনাম হয় ‘বার্লিন হামলার পর টরোন্টো ক্রিসমাস বাজারের নিরাপত্তা জোরদার’।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতকালীন বন্ধ শুরু হয়ে গেল। কাল ক্রিসমাস বাজারে যাব ভাবছি। ওয়েদার নেটওয়ার্কে ঝটপট দেখে নিই আগামীকাল তাপমাত্রা থাকবে শূন্যের নীচে ৫ ডিগ্রি, অনুভূত হবে শূন্যের নীচে ১৩ ডিগ্রী। ঠিক হ্যায়, তাও চলবে। বড়দিন উপলক্ষে বড় বড় সেল লেখা দোকানগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জীবন খুঁজতে থাকি বরফে মোড়া টরোন্টোর রাস্তায়। স্বচ্ছ বরফের নীচ থেকে প্রোথিত গোপন শেকড় টেনে নিয়ে যায় বাংলা বাজারে ছাপা হতে থাকা আগামী বছরের বইমেলার পাতায় পাতায়, হাতিরঝিলের ঝোল ঝোল মাখা ভোরের কুয়াশায়...
টরোন্টোর চিঠিতে করে সবার কাছে পৌঁছে যাক বড়দিনের শুভেচ্ছা আর নতুন বছরের ভালোবাসা...

২১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ডাউনটাউন, টরোন্টো