২০১৬ সালের ম্যান বুকার পুরস্কার বিজয়ী হলেন আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ঔপন্যাসিক এবং কবি পল বেটি । তাঁর চতুর্থ ঊপন্যাস ‘দ্য সেলআউট’-এর জন্য তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন। উল্লেখ্য, বিশ্বসাহিত্যে বিশিষ্ট অবদান রাখার জন্য প্রদত্ত নোবেল পুরস্কারের পর ইংরেজি ভাষাভাষি লেখকদের জন্য সবচেয়ে সম্মানিত এবং মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হচ্ছে ‘ম্যান বুকার’ (সংক্ষেপে ‘বুকার’) পুরস্কার। যুক্তরাজ্য, কমনওয়েলথ্ অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ এবং ইংরেজি ভাষাভাষি নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের লেখকদের মধ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য উপন্যাসের জন্য ১৯৬৯ সাল থেকে শুরু করে ২০১৩ সাল পর্য্যন্ত এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে । কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে নিয়ম পরিবর্তন করে এসব দেশের লেখকদের উপন্যাসের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেখকদের উপন্যাসও পুরস্কার প্রাপ্তির বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে পল বেটি প্রথম ঔপন্যাসিক যিনি ম্যান বুকার পুরস্কার জয় করেন ।
‘ম্যান বুকার’ পুরস্কারের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, যা শুরু থেকে আজ পর্য্যন্ত অপরিবর্তিত, বিজ্ঞ বিচারকমন্ডলীর বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো উপন্যাসকে নির্বাচিত করা হয়, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ঔপন্যাসিককে নির্বাচন করা হয় না । তাহলে দেখা যাক, পল বেটির ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসে কী এমন কাহিনী, যাদু এবং চুম্বক শক্তি আছে, যা তাঁকে এই সম্মানিত পুরস্কারের বিজয় মালা পরিয়ে দিলো ।
‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী লস এঞ্জেলেসের কাল্পনিক এক শহরতলীর একজন কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে ঘিরে । উপন্যাসের অধিবক্তা এই যুবককে সমাজের মূলধারা থেকে বাইরে এনে বর্ণবাদ ও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে দাসপ্রথা এবং সামাজিক শ্রেনীবিভেদ পুনর্বহাল করার কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে । এ কথা সত্যি যে, মার্কিন বর্ণবাদের ওপর ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে সাহিত্য সমালোচক এবং বোদ্ধা পাঠকেরা এটিকে রীতিমতো বিদ্রুপাত্বক এবং রম্য রচনা হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে । কিন্তু লেখক হিসেবে পল বেটি মনে করেন এই উপন্যাসের ভেতর রয়েছে গভীরতা । এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘উপন্যাসটির বাহ্যিক উপাদান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করার জন্য ভেতরের লুকানো বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়েছে ।’
যাহোক, ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাস সম্পর্কে বুকার কমিটির বিচারকমন্ডীর প্রধান অ্যামান্ডা ফোরম্যান মন্তব্য করে বলেছেন, ‘এই উপন্যাস সামাজিক ট্যাবুর অন্ধকারাচ্ছন্ন ও সঙ্কীর্ণতাকে আলোর পথের দিকনির্দেশনা করেছে ... আমাদের সময়ের একটি সেরা উপন্যাস, যা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ঠুর কল্পনা ।’ তিনি আরো বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে এটি প্রথম শ্রেনীর একটি রাশভারী উপন্যাস, যা ব্যঙ্গ-কৌতুকের চাদরে মোড়ানো ।’ এছাড়া বিজ্ঞ পাঁচজন বিচারক ঐকমত্যে পৌঁছেন এবং একই সুরে মন্তব্য করে বলেন, ‘এই উপন্যাস আমেরিকার অতীতের বর্ণবাদী পরিচয় এবং অবিচারের বাস্তব ঘটনা নিয়ে রচিত বর্তমান সময়ের একটি শ্রেষ্ঠ হাস্য- কৌতুক উপন্যাস ।’ হয়তো এ কারণেই বিচারকমন্ডলী পল বেটিকে মার্ক টোয়েন এবং জোনাথান সুইফটের সঙ্গে একই কাতারে শামিল করেছেন । বৃটেনের বিখ্যাত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় এলিজাবেথ ডোনেলী ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসকে বর্ণনা করেন ‘কর্তৃত্ব-সম্পন্ন কাজ, যা বেটিকে আমেরিকার একজন কৌতুক লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ।’ এছাড়া সমালোচক রেনি এডো-লজ উপন্যাসটিকে সম্বোধন করেছেন, ‘ব্যঙ্গ- বিদ্রুপের ঘূর্ণি-হাওয়া ।’
ফ্রান্সেস গার্টলার (লন্ডনের বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘ফয়েলস্’-এর ওয়েব এডিটর) ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসকে বর্ণনা করেছেন, ‘স্মরণযোগ্য কথকের তীব্র হুল ফোঁটানো কৌতুক ...সাহসী এবং হাস্যকর । তবে গভীরে যেতে একটু সময় লাগে, কিন্তু পাঠক একবার উপন্যাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে আর ফিরে আসতে চাইবে না ।’ অন্যদিকে ক্রিস হোয়াইট (বৃটেনের ‘ওয়াটারস্টোনস্’ বইয়ের দোকানের বিক্রেতা) বলেছেন, ‘বুকারের বিচারকেরা মূল্যবান সাহিত্য পুরস্কারের জন্য এমন এক উপন্যাসকে বেছে নিয়েছে, যা এই অদ্ভুত এবং কঠিন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে ।’
লন্ডনের বিখ্যাত ‘ওয়াল ষ্ট্রীট জার্ণাল’-এর স্যাম স্যাকস্ বলেছেন, ‘উচ্চ মার্গের চতুর বিদ্রুপ... ঘোরলাগা, জ্বালাময়ী এবং ঝলমলে ।’ অন্যদিকে ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’-এর কিছে লেমন বলেছেন, ‘[দ্য সেলআউট] একুশ শতকের আমেরিকার সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ এবং জটিল উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম ... এটা এমন একটা হৃদয় নিংড়ানো উপন্যাস, যা পাঠকরা হয়তো কখনই ভুলবে না ।’
পুরস্কার প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে উপন্যাস সম্পর্কে লেখক বলেছেন, ‘বইটি বড্ড জটিল এবং লেখার সময় আমি প্রচন্ড কঠিন সময় অতিক্রম করেছি । আমি এ-ও জানি, এই বই পাঠকের জন্য পড়াও বেশ কঠিন হবে । কেননা প্রত্যেকেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি পড়বে ।’ এছাড়া উপন্যাস লেখার অনুপ্রেরণা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নির্ধিদ্বায় স্বীকার করেছেন, ‘[তিনি] দেউলিয়া ছিলেন ।’ উল্লেখ্য, ম্যান বুকার পুরস্কার ছাড়াও এই উপন্যাসের জন্য পল বেটি তাঁর বিজয় মুকুটে আরো পালক যুক্ত করতে পেরেছেন, যেমন ২০১৫ সালের ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কেল অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়া নিউ ইয়র্ক টাইমস্ এবং ওয়াল ষ্ট্রীট জার্নালের জরিপে ২০১৫ সালের সেরা বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে ।
‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসের আগে জর্জ অরওয়েল এবং কুর্ট ভনেগার্টের লেখার ভক্ত পল বেটির ঝুলিতে আরো তিনটি উপন্যাস রয়েছে । এগুলো হলো: ‘দ্য হোয়াইট বয় শাফল্’ (১৯৯৬), ‘টাফ’ (২০০০) এবং ‘স্লাম্বারল্যান্ড’ (২০০৮)। লস এঞ্জেলেসের একজন কৃষ্ণাঙ্গ সার্ফারের জীবনী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘দ্য হোয়াইট বয় শাফল্’। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন খবরের কাগজ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সমালোচক রিচার্ড বার্নষ্টেইন ‘দ্য হোয়াইট বয় শাফল্’ উপন্যাসের ভূঁয়সী প্রশংসা করেন । তিনি বলেন, ‘কৃষ্ণ আমেরিকানের হৃদয় থেকে নির্গত এক ঝলক কৌতুকপূর্ণ বিস্ফোরণ ।’ এছাড়া ‘টাফ’ উপন্যাস ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ইতিবাচক মন্তব্য লাভে সক্ষম হয় । ‘স্লাম্বারল্যান্ড’ উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে বার্লিনে একজন আমেরিকান ডিস্ক জকির জীবনকাহিনী নিয়ে । উপন্যাস ছাড়াও তিনি ২০০৬ সালে ‘হকুম: অ্যান এন্থোলজি অফ আফ্রিকান আমেরিকান হিউমর’ শিরোনামে একটি সংকলন সম্পাদন করেন এবং একই বিষয়ে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন । বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সমাজের অবহেলিত মানুষ এবং তাদের মানসিক পরিস্থিতি ও আশা-হতাশার মতো মানবিক বিষয়গুলো তাঁর লেখার মূল প্রতিপাদ্য । এসব স্পর্শকাতর ও জটিল বিষয়গুলো তিনি হাস্য-পরিহাসের মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন ।
পল বেটি শুধু একজন উঁচু মাপের ঔপন্যাসিক নন, তিনি কবি হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন । তিনি কবিতা দিয়ে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন । শুরুতে তিনি হিপ-হপ স্টাইলে কবিতা লেখেন এবং তাঁকে ‘হিপ-হপ পোয়েট লরিয়েট’ খেতাবে ভূষিত করা হয় । কবি হিসেবে তিনি ১৯৯০ সালে প্রথম ‘গ্র্যান্ড পয়েট্রি স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন’ শিরোপা লাভ করেন । এই শিরোপা লাভের পুরস্কার হিসেবে তিনি কবিতার বই প্রকাশ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন এবং ১৯৯১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিগ ব্যাঙ্ক টেইকস্ লিটল্ ব্যাঙ্ক’ প্রকাশিত হয় । তাঁর প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ হলো ‘জোকার, জোকার, ডিউস্’ (১৯৯৪) । পরবর্তীতে তিনি এই কাব্যগ্রন্থের কবিতা এমটিভি এবং পিবিএস চ্যানেলের দ্য ইউনাইটেড স্টেটস্ অফ পয়েট্রি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন । ১৯৯৩ সালে তিনি ‘ফাউন্ডেশন ফর কন্টেম্পোরারী আর্টস গ্র্যান্টস্ টু আর্টিষ্টস্’ অ্যাওয়ার্ড পান ।
পল বেটির জন্ম ১৯৬২ সালে, ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের লস এঞ্জেলেস শহরে । মাত্র তিন বছর বয়সে তাঁর বাবা পরিবার ছেড়ে অন্যত্র চলে যান এবং আট বছর বয়সে মা এবং দুই বোনের সঙ্গে পশ্চিম লস এঞ্জেলেসে বাস করেন । তিনি ১৯৮০ সালে উডল্যান্ড হিলস এলাকার এক হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন । শৈশবে তিনি তাঁর মায়ের পাঠাগারে বই পড়া শুরু করেন । তখন থেকেই বই পড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মে । ‘হকুম: অ্যান এন্থোলজি অফ আফ্রিকান আমেরিকান হিউমর’ সংকলনের ভূমিকায় তিনি স্বীকার করেছেন যে, স্কুলে থাকাকালীন তাঁকে মায়া এঞ্জেলোর ‘আই নো হোয়াই দ্য কেইজডস্ বার্ড সিঙস্’ দেওয়া হয় । তিনি মাত্র তিন পৃষ্ঠা পড়েই আর এগোননি । কেননা তাঁর কাছে বিরক্তকর লেগেছে । পরবর্তীকালে তিনি দশ বছর আফ্রিকান- আমেরিকান সাহিত্য পড়েননি, এমনকি ধারে কাছেও যাননি । পল বেটির মা ছিলেন নার্স এবং রংতুলি শিল্পী । মা হিসেবে তিনি ছেলেমেয়েদের যোসেফ হেলার, সল
বেলো, বৌদ্ধধর্ম এবং জাপানী সামুরাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন । কিন্ত কখনই তিনি ছেলেমেয়েদের ওপর তাঁর বিশেষ কোনো দর্শন, রাজনীতি কিংবা ধর্ম চাপিয়ে দেননি । স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে পল বেটি বোস্টনে চলে যান এবং বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে মনোবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন । পরে তিনি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন কলেজ থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ মাস্টার্স অফ ফাইন আটস্র্ ডিগ্রী লাভ করেন । যদিও তিনি বিখ্যাত ‘বীট’ কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে ব্রুকলিন কলেজে ছিলেন, কিন্তু অনেক সহপাঠী এবং শিক্ষকরা তাঁর কবিতার মধ্যে নাগরিক বিষয়বস্তুকে ঠিক মতো বুঝতো না । ফলে ক্রমশ তিনি কবিতা লেখার প্রতি বিমুখ হন এবং একসময় নিজেকে কবিতার জগত থেকে গুটিয়ে এনে কথাসাহিত্যে সমর্পণ করেন । অবশেষে এই কথাসাহিত্যই তাঁকে ম্যান বুকার পুরস্কারের বিজয় মুকুট মাথায় পড়িয়ে দিয়েছে । বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করেন ।