চোখ বুজতেই বাতাসের মিষ্টি গন্ধ পেলাম। সেটা ছিল একটা ফলের মতো ফুলে-ওঠা মে মাসের বাতাস। একটা ফলের মতো এর রন্ধ্রময় খোসা, আঠাল শাঁস, আর পাউডারের মতো বীজও ছিল। মধ্যগগনে এর শাঁসটা ফেটে ফেটে পড়ছিল আর এর বীজগুলো ছররার মতো আমার নগ্ন বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। থেকে যাচ্ছিল শুধু ক্ষীণ একটা ব্যথা।
“হুঁ, কটা বাজল?” আমার কাজিন জিজ্ঞেস করল। উচ্চতার ২০ সেন্টিমিটার পার্থক্যের কারণে কথা বলতে গেলেই তাকে মুখ উঁচু করে আমার দিকে তাকাতে হচ্ছিল।
আমি একপলক আমার হাতঘড়িটার দিকে তাকালাম, “দশটা কুড়ি।”
“ঘড়িটা কি ঠিক টাইম দেয়?”
“তাই তো মনে হয়।”
আমার কাজিন খপ করে আমার কব্জি আঁকড়ে ধরে ঘড়িটার দিকে তাকাল। তার আঙুলগুলো পাতলা পাতলা আর মসৃণ, কিন্তু দেখলে যেরকম মনে হয় তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। “এটা কি খুব দামি?”
“না। বেশ সস্তাই।” আরেকবার ঘড়িটার ডায়ালের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম।
সে চুপ করে রইল।
আমার কাজিনের দিকে তাকিয়ে দেখি সে উৎকণ্ঠিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষয়াটে হাঁড়ের মতো তার শাদা শাদা দাঁতগুলো তার ঠোঁটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে। “এটা সত্যি বেশ সস্তাই ছিল,” তার দিকে তাকিয়ে আমি আবার পরিস্কার এবং স্পষ্ট করে বললাম। “তবে, এটা কিন্তু বেশ ভালোই টাইম দেয়।”
সে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
আমার কাজিনের ডান কানে একটা সমস্যা আছে। প্রাথমিক স্কুলে ঢোকার পরপরই তার কানে একটা বেসবলের ধাক্কা লাগে, এবং তারপর থেকে তার শুনতে প্রায়ই একটু সমস্যা হয়। তারপরও অবশ্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এটা তার প্রাত্যহিক জীবনের কোনো অন্তরায় বলে মনে হয় না। সে স্বাভাবিকভাবেই স্কুলে যাতায়াত করে আর এই ব্যাপারটা ছাড়া একদম আগের মতোই জীবনযাপন করে। শুধু ক্লাসে সে তার বাম কানটা শিক্ষকদের দিকে খাড়া করে রাখে, আর সব সময় বসে একদম প্রথম সারির ডানদিকটায়। তার গ্রেডও খুব একটা খারাপ নয়, যদিও মাঝে মাঝে এমন হয় যে সে আর বাইরের শব্দ-টব্দ ঠিকমতো শুনতে পায় না, আবার মাঝে মাঝে ভালোই শুনতে পায়। উঁচু-নিচু ঢেউয়ের মতো পর্যায়ক্রমে এটা আসে। তারপর আবার তার খুব খারাপ অবস্থাও হয়, হয়তো ছয়মাসে একবার, যখন সে কোনো কানেই আর কিছুই শুনতে পায় না। যেন তার ডান কানের নৈঃশব্দ্য গভীর হতে হতে তার বামদিকের সমস্ত— শব্দকে পরাভূত করে নিষ্পিষ্ট করে দেয়। সেটা ঘটলে সে স্বভাবতই আর স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে পারে না, তখন তাকে কিছুদিন স্কুলটাও বাদ দিতে হয়। ডাক্তাররা এই ব্যাপারগুলোর কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেন না যেহেতু এইরকম আর কোনো কেস নাই। বলাবাহুল্য, তাঁরা এই অবস্থার কোনো চিকিৎসাও করতে পারেন না।
“হ্যাঁ, ঘড়ি দামি হলেই যে ঠিক টাইম দেবে তার কোনো মানে নেই,” আমার কাজিন বলল, যেন সে এই সত্যটা নিজেকেই বুঝাতে চাইছে। “আমি যে ঘড়িটা ব্যবহার করতাম সেটা তো বেশ দামিই ছিল, কিন্তু সেটা সব সময় গোলমাল করত। হাইস্কুলের শুরুতে বাপ-মা আমাকে ওইটা কিনে দিলেন। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই আমি সেটা হারিয়ে ফেললাম, আর তখন থেকেই আমি ঘড়ি-টড়ি ছাড়াই চালিয়ে যাচ্ছি... কারণ তাঁরা আর আমাকে কোনো ঘড়ি কিনে দিলেন না।”
“ঘড়ি না-থাকাটা নিশ্চয় খুব ঝামেলার।” আমি বললাম।
“এ্যাঁ?” আমার কাজিন উত্তর দিল।
“ঘড়ি না-থাকাটা খুব ঝামেলার না?” তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আমি আবার পুনরাবৃত্তি করলাম।
“ঠিক তা নয়,” মাথা ঝাঁকিয়ে সে উত্তর দিল, “আমি তো আর একা একা পাহাড়ে বসবাস করি না... সব সময়ই কারো না কারো কাছ থেকে সময়টা জেনে নিই।”
“হ্যাঁ, তাই তো।” আমি বললাম।
এবং আবার আমরা চুপ হয়ে গেলাম।
ভালোই বুঝতে পারছি তার সঙ্গে আমার একটু সদয় হওয়া দরকার, একটু কথাবার্তা বলা দরকার; হসপিটালে পৌঁছানোর আগেই তার নার্ভাসনেসটা অন্তত একটু শিথিল করে দেওয়া দরকার। কিন্তু আমাদের শেষ দেখা হয়েছে এখন থেকে পাঁচ বছর আগে, আর এই সময়ের মধ্যে আমার এই ভাইটা নয় থেকে চৌদ্দ হয়ে গেছে, আর আমি কুড়ি থেকে পঁচিশ হয়ে গেছি। ওই ফাঁকা সময়টা আমাদের মধ্যে একটা ঈষদচ্ছ বিভাজক খাড়া করে দিয়েছে যেটা ভেদ করা আমাদের জন্যে বেশ কঠিনই। এমনকি আমি যখন খুব জরুরি কোনো কথাও বলতে চাইছি, তখনও যেন সঠিক শব্দটা ঠিক মনে আসছে না। আর যখনই আমি আমতা-আমতা করছি, বা আমার কথাবার্তা জড়িয়ে যাচ্ছে, সে তার বাম কানটা আমার দিকে সামান্য খাড়া করে বিহ্বল মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকছে।
“এখন কয়টা বাজে?” আমার কাজিন জিজ্ঞেস করল।
“দশটা উনত্রিশ,” আমি উত্তর দিলাম।
দশটা বত্রিশে বাসটা এল।
আমি যে বাসটায় হাইস্কুলে যাতায়াত করতাম তার তুলনায় এই বাসটার আকার-আকৃতি অনেক আধুনিক। এর ড্রাইভারের আসনের সামনের উইন্ডশিল্ডটা অনেক চওড়া। আর গাড়িটাকে একটা বিশাল ডানাকাটা বম্বারের মতো লাগছিল। তার ওপর আবার বাসটা অপ্রত্যাশিতরকম জনাকীর্ণ। মাঝের আইলটাতে যদিও কেউ দাঁড়ানো ছিল না, তবু আমরা পাশাপাশি সিট ম্যানেজ করতে পারলাম না। আমরা না-বসার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং যেহেতু আমাদের গন্তব্যটা খুব দূরে নয় তাই পেছনের দরজার সামনের জায়গাটা দখল করলাম। দিনের এই সময়টায় বাসটাতে এত লোক কেন সেটা আমার বোধগম্য হলো না। এই বাসরুটটা একটা প্রাইভেট রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে কিছু পাহাড়ি আবাসিক জেলার মধ্যে দিয়ে ঘুরে আবার সেই রেলস্টেশনেই ফিরে গেছে; এবং এই রুটে কোনো উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান বা তেমন কোনো সুযোগসুবিধাও নেই। এই রুটে কিছু স্কুল পড়ে, কাজেই স্কুলে যাতায়াতের সময়টায় বাসটা জনাকীর্ণ থাকতেই পারে, কিন্তু দুপুরবেলায় বাসটা একদম ফাঁকাই থাকার কথা।
আমার কাজিন আর আমি দুজনেই একহাতে স্ট্র্যাপ আর অন্যহাতে বার ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাসটা এত ঝকঝক করছিল যেন সেটা এইমাত্র ফ্যাক্টরি থেকে বানিয়ে বের করা হয়েছে। এর নির্মল ধাতব অংশটা এত পরিষ্কার ছিল যে তার মধ্যে দিয়ে আপনি পরিষ্কার নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পারতেন, আর সিটের ওপরকার রোমশ গদিটা ছিল আঁটসাঁট আর পরিচ্ছন্ন। বাসটার প্রত্যেকটি স্ক্রু থেকেও যেন অহঙ্কার আর আশাবাদের একটা আবহ বিকিরিত হচ্ছিল, নতুন মেশিনপত্রে যেমনটি প্রায়ই দেখা যায়।
এই নতুন বাসটা, এর অপ্রত্যাশিতসংখ্যক যাত্রী, আমাকে ধন্দে ফেলে দিল। হতে পারে এই রুটের ব্যাপারস্যাপার সম্পূর্ণই পাল্টে গেছে, যা আমি জানিই না। আমি মনোযোগ দিয়ে আমার চারপাশে বাসের ভেতরটা দেখতে লাগলাম, তারপর জানালা দিয়ে বাইরেটা নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। কিন্তু যা দেখলাম সেটা অবিকল সেই একই শুনশান শহরতলীর দৃশ্য যা আমার স্মৃতিতে রয়েছে।
“এই বাসটাই তো, না?” আমার কাজিন উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল। বাসে ওঠার পর থেকে নিশ্চয় আমি একটা হতভম্ব মুখ করে আছি।
“ঠিকই আছে,” যেন খানিকটা নিজেকেই আশ্বস্ত করছি এইভাবে আমি বললাম, “ভুল হতেই পারে না। এদিক দিয়ে আর কোনো বাসরুট নেই।”
“তুমি কি এই বাসেই স্কুলে যাতায়াত করতে?” আমার কাজিন জিজ্ঞেস করল।
“ঠিক তাই।”
“স্কুল তোমার ভাল্লাগতো?”
“না, তা লাগত না।” সম্পূর্ণ সৎভাবে আমি উত্তর দিলাম। “কিন্তু সেখানেই আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো, আর সেটা যে খুব যন্ত্রণাকর ছিল, তা নয়।”
আমার কাজিন আমার কথাটা নিয়ে একটু ভাবল।
“সেসব বন্ধুদের সঙ্গে তোমার এখনো দেখা হয়?”
“না, বহুদিন তাদের কারও সঙ্গেই আর দেখা হয় নাই।” সতর্কভাবে শব্দচয়ন করে করে আমি উত্তর দিচ্ছিলাম।
“কেন? তাদের সঙ্গে তুমি আর দেখা করো না কেন?”
“ও, তার কারণ আমরা এখন পরস্পর থেকে অনেক দূরে দূরে থাকি।” এটা অবশ্য সত্য নয়, কিন্তু আর কোনোভাবে এটা ব্যাখ্যা করা যায় না।
আমার পাশেই একদল বয়স্ক নাগরিক বসে আছেন। সব মিলিয়ে জনা পনেরোর মতো। তাঁদের জন্যেই বাসটা আসলে এত জনাকীর্ণ লাগছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই বেশ ভালোই রোদে-পোড়া; তাঁদের প্রত্যেকেরই ঘাড়ের পেছন দিকটা একইভাবে ব্রোঞ্জরাঙা হয়ে নিচে নেমে গেছে। ব্যতিক্রমহীনভাবে তাঁরা প্রত্যেকেই অসম্ভবরকম শীর্ণকায়। পুরুষদের অধিকাংশেরই পরনে পর্বতারোহী-টাইপের ভারি শার্ট; আর মহিলোাদের পরনে সম্পূর্ণ কারুকার্যহীন নিতান্ত সাদামাটা ধরনের ব্লাউজ। সবারই কোলের ওপর ছোট আকারের পিঠে-ঝোলানো একটা ব্যাগ, ছোটোখাটো পর্বতারোহণে যেমনটি ব্যবহার করা হয়। তাঁরা দেখতে অদ্ভুতরকমভাবে সদৃশ, যেন একই স্যাম্পল ড্রয়ার থেকে বের করা একইরকম জিনিস। তারপরও অবশ্য তাঁদের ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। এই বাসরুটের সঙ্গে পর্বতারোহণের কোনো রাস্তাই নেই। তাহলে তাঁরা যাচ্ছেনটা কোথায়? স্ট্র্যাপে ঝুলতে ঝুলতে আমি এইসব ভাবতে লাগলাম, কিন্তু সম্ভাব্য কোনো ব্যাখ্যা মাথায় এল না।
০ ০ ০
“এইবারের থেরাপিতে ব্যথা লাগবে কি না কে জানে!” আমার কাজিন বলল।
“হ্যাঁ, তাই তো।” আমি উত্তর দিলাম, “এই জাতীয় জিনিস আমি আগে কখনো শুনি নাই।”
“তুমি কখনো কানের ডাক্তার দেখিয়েছ?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম। চিন্তা করে দেখলাম সারাজীবনে আমি কখনো কানের ডাক্তার দেখাইনি।
“এত দিন কি তোমার খুব ব্যথা লেগেছে?” আমি জানতে চাইলাম।
“না, সবগুলো সেরকম না।” গোমড়ামুখে আমার কাজিন উত্তর দিল। “একদমই যে লাগে না তা না। মাঝে মাঝে একটু লাগে, তবে সেটা খুব যন্ত্রণাদায়ক বলা যাবে না।”
“তাহলে আমার মনে হয় এবারেরটাও আগের মতোই হবে। তোমার মা যা বলছিলেন তাতে মনে হয় তাঁরা এবার আগের তুলনায় তেমন আলাদা কিছু করবেন না।”
“কিন্তু তাঁরা যদি আলাদা কিছু না-ই করেন, তাহলে তো এবারও কোনো লাভ হবে না।”
“এখনই আমরা সেটা বলতে পারি না। কাজ হবে সেই সম্ভাবনাটা সব সময়ই থাকে, তাই না?”
“হঠাৎ একটা কর্ক বেরিয়ে আসার মতো?” আমার কাজিন বলল। চকিতে আমি তার মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু সে রসিকতা করছে বলে মনে হলো না।
“ডাক্তার পাল্টালে পুরো অবস্থাটাই পাল্টে যেতে পারে, আর তার চেয়েও বড় কথা হলো, পদ্ধতির সামান্য একটু হেরফেরও অনেক বড় পার্থক্য তৈরি করতে পারে। আমাদের ওরকম হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।”
“হাল ছেড়ে দিয়েছি বলি নাই।” আমার কাজিন বলল।
“কিন্তু তুমি কি এটা নিয়ে ফেডআপ হয়ে যাচ্ছ?”
“তা-ই মনে হয়,” এই বলে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। “এর সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা হলো ভয়। ওই সময় যে ব্যথাটা লাগে সেটা চিন্তা করলেই ভয় লাগে। আসল ব্যথার চেয়েও আমি এইটাকে বেশি ঘেন্না করি। তুমি কি বুঝতে পারছ?”
“বোধ হয়,” আমি উত্তর দিলাম।
ওই বছর বসন্তে বহু কিছুই ঘটে গেল। টোকিওর যে ছোট্ট বিজ্ঞাপনী সংস্থাটায় আমি দুই বছর ধরে কাজ করছিলাম সেখানে একটা বিশেষ পরিস্থিতির কারণে আমি কাজটা ছেড়ে দিলাম। ওই সময়, কলেজ থেকে পরিচিত যে মেয়েটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সেটাও ভেঙে গেল। তার পরের মাসে আমার দিদিমা অন্ত্রের ক্যান্সারে মারা গেলেন; তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দিতে আমি ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে পাঁচ বছর পর প্রথমবারের মতো আবার এই শহরে ফিরে এলাম। বাসায় ফিরে দেখি আমার রুমটা অবিকল যেরকম রেখে গিয়েছিলাম সেরকমই রয়েছে। আমি যে বইগুলো পড়তাম সেগুলো শেলফের ওপরেই রয়েছে; যে বিছানাটায় ঘুমাতাম, যে ডেস্কটা ব্যবহার করতাম, এবং যে রেকর্ডগুলো শুনতাম, সে সবই সেখানে রয়েছে। কিন্তু ঘরের সবকিছুই কেমন যেন শুকিয়ে জীর্ণ হয়ে গেছে, আর বহু আগেই সেগুলোর রঙ আর গন্ধ নষ্ট হয়ে গেছে। সময়টাই শুধু বিস্ময়করভাবে থমকে আছে।
দিদিমার শেষকৃত্যের পর ভেবেছিলাম দু’তিন দিন বাসায় একটু রেস্ট নিয়ে আবার টোকিওতে ফিরে যাব। এমন নয় যে সামনে আমার আর কোনো চাকরি-বাকরি নেই, এবং আমার সেই চেষ্টাটা করার সম্পূর্ণ ইচ্ছেও ছিল। পুরোনো অ্যাপার্টমেন্টটা ছেড়ে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে চাইছিলাম।
কিন্তু সময় যত গড়াতে লাগল ততই আমার পক্ষে উঠে চলে যাওয়াটা দুরূহ থেকে দুরূহতর হয়ে উঠল। বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে, চলে যেতে চাইলেও আমি ইতিমধ্যে যাবার ব্যাপারে অক্ষম হয়ে গেছি। নিজেকে আমার ঘরটার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছি, সেই পুরোনো রেকর্ডগুলোই শুনছি, অতীতের সেই বইগুলোই আবার পড়ছি, আর মাঝে মাঝে আঙিনার ঘাস-টাস পরিষ্কার করছি। পরিবারের লোকজন ছাড়া কারও সঙ্গেই কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না।
ওইরকম একটা দিনে, আমার কাকিমা এসে বললেন যে আমার কাজিনকে এখন নতুন একটা হসপিটালে যেতে হবে, এবং জানতে চাইলেন আমি তাকে দয়া করে সেখানে একটু সঙ্গ দিতে পারি কি না। আসলে তাঁর নিজেরই যাওয়া উচিত ছিল, তিনি বললেন, কিন্তু ওইদিন তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। তাঁকে আমার প্রত্যাখ্যানের কোনো কারণ ছিল না; আর সময় তো আমার ছিলই, এবং যেহেতু হসপিটালটা আমার পুরোনো স্কুলের কাছেই, আমি জানতাম সেটা ঠিক কোথায়। কাকিমা আমার কাজিনের সঙ্গে ভালো একটা খাওয়াদাওয়া করে নেবার জন্যে কিছু টাকাভর্তি একটা খামও আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
হসপিটাল পরিবর্তনটা এইজন্যে যে, আগের যে হসপিটালটায় সে চিকিৎসা নিচ্ছিল সেই চিকিৎসায় তার কোনো কাজই হয় নাই। আসলে তার বধিরতাচক্র আগের তুলনায় আরও ঘন ঘন ফিরে আসছিল। কাকিমা যখন ডাক্তারদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন তখন সে ঘোষণা করে বসল যে, সমস্যাটা এই বাহ্যিক, চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিষয়াদির ফলাফল নয়, বরং তার বাড়ির পরিবেশটাই এর জন্যে দায়ী; আর এতে করে প্রায় একটা ঝগড়াই বেধে গেল। সত্যি বলতে কি, হসপিটাল পাল্টালেই যে তার শোনার ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে সেটা কেউই আশা করছিল না। যদিও তারা কেউই সেটা বলছিল না, কিন্তু তার চারপাশের প্রায় সবাই-ই তার এবং তার কানের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল।
যদিও আমাদের বাড়িগুলো বেশ কাছাকাছিই ছিল, কিন্তু দশ বছরেরও বেশি বয়সের পার্থক্যের কারণে আমি আর আমার কাজিন খুব একটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। শুধু আত্মীয়রা একজায়গায় হলে আমি হয়তো তাকে কোথাও নিয়ে-টিয়ে যেতাম বা একসাথে খেলা-টেলা করতাম। যদিও কখন জানি আমরা একটা জুড়ি হয়ে গেলাম আর আমাদেরকে একসঙ্গে দেখা যেতে লাগল। তারা ধরেই নিল যে সে আমার খুব অনুরক্ত এবং আমি তাকে খুব পছন্দ করি। বহুদিন আমি এর কারণটা বুঝতে পারি নাই। এখন সে যে-ভঙ্গিতে তার মাথাটা সামান্য নুয়ে বাম কানটা আমার দিকে পেতে রেখেছে, তা দেখে আমি তার প্রতি একটা অদ্ভুত ভালবাসা বোধ না করে পারলাম না। বহুকাল আগে শোনা বৃষ্টিপাতের শব্দের মতো তার এই অস্বস্তিকর ছোটখাটো ভঙ্গিগুলোর মধ্যে যেন আমার কোনো ভালোলাগা মিশে আছে। এবং কেন আত্মীয়স্বজন আমাদের দুজনকে এক করে দ্যাখে সেটা যেন এখন আরেকটু ভালো করে বুঝতে পারলাম।
সাত-আটটা স্টপেজ পার হওয়ার পর, আমার কাজিন আবার তার উৎকণ্ঠিত মুখটা উঁচু করে আমার দিকে তাকাল।
“আরও সামনে?”
“আরও সামনে, সেটা একটা বিরাট হসপিটাল, কাজেই আমরা সেটা মিস করব না।”
আমি অন্যমনস্কভাবে জানালার বাতাসে কম্পমান বর্ষিয়ানদের হ্যাটের কর্ড আর স্কার্ফের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তাঁরা আসলে কারা? এবং তাঁরা যাচ্ছেনই বা কোথায়?
“এই, তুমি কি আমার বাবার কোম্পানিতে কাজ করবে?” আমার কাজিন বলল।
বিস্মিত হয়ে আমি তার দিকে তাকালাম। আমার কাজিনের বাবা, মানে আমার কাকা, কোবেতে একটা বড় প্রিন্টিং কোম্পানি চালান। আমি কখনো সেরকম কিছু ভাবি নাই, কেউ আমাকে সেরকম কোনো ইঙ্গিতও দেয় নাই।
“এই প্রথম আমি এরকম কথা শুনলাম...” আমি বললাম। “কিন্তু হঠাৎ এই কথা কেন?”
আমার কাজিন লাল হয়ে গেল। “না এমনিই ভাবছিলাম তুমি হয়তো করতেও পারো।” সে বলল। “কিন্তু সেটা করলে খুব দারুণ হতো না? তখন তুমি এখানে থেকে যেতে পারতে। আর তুমি এখানে থেকে গেলে সবাই কত খুশি হতো!”
একটা রেকর্ডিং পরবর্তী বাসস্টপের ঘোষণা দিল, যদিও কেউ নামার বাটনটা টিপল না। স্টপেজে কোনো অপেক্ষমাণের সঙ্কেতও ছিল না।
“কিন্তু টোকিওতে আমার কিছু কাজ আছে, তাই আমাকে ফিরতেই হবে,” আমি বললাম। সে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
কোথাও এমন কিছুই নেই যা আমাকে করতেই হবে। কিন্তু এই একটি জায়গা যেখানে আমি কোনোভাবেই থাকতে পারব না।
বাসটা একটা খাড়াই বেয়ে ওঠা শুরু করতেই ঘরবাড়ি পাতলা হয়ে আসতে লাগল আর ডালপালার ঘন পত্ররাজি রাস্তার ওপর গাঢ় ছায়া ফেলতে লাগল। নিচু বেড়া দিয়ে ঘেরা, নানান রঙের বিদেশী বাড়িগুলো চোখে পড়তে লাগল। বাতাসটা একটু ঠাণ্ডা হয়ে এল। প্রত্যেকবার বাসটা বাঁক নিলেই সমুদ্র চকিতে দেখা দিয়েই আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। হসপিটালটা না আসা অবধি আমি আর আমার কাজিন ওই দৃশ্যে বুঁদ হয়ে রইলাম।
আমার কাজিন বলল যে যেহেতু তার ট্রিটমেন্টে একটুু সময় লাগবে কাজেই আমি ওই সময়টা বাইরেই অপেক্ষা করতে পারি, এবং সে একাই এর জন্যে যথেষ্ট। ডিউটি ডাক্তারকে ছোট একটা বাউ করে আমি টেস্টরুমটা থেকে বেরিয়ে সোজা ক্যাফেটেরিয়ার দিকে চলে গেলাম। সকালে কোনোমতে নাস্তা সারায় বেশ ক্ষুধা-ক্ষুধা লাগছিল, কিন্তু মেন্যুটা দেখে কিছুই খেতে ইচ্ছা করল না। শেষ পর্যন্ত শুধু এক কাপ কফির অর্ডার দিলাম।
কার্যদিবসের সকাল, তাই ক্যাফেটেরিয়ায় শুধু একটাই দর্শনার্থী পরিবার আমার পাশের টেবিলটায় বসে ছিল। মধ্যচল্লিশের যে লোকটাকে আমি বাবা বলে ধরে নিলাম, তার পরনে ছিল একটা নেভি-ব্লু স্ট্রাইপের গাউন আর পায়ে ভিনাইলের স্লিপার। মা আর যমজকন্যাদুটি নিশ্চয়ই লোকটির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। যমজদুটির পরনে একইরকম শাদা জাম্পার এবং তারা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে গম্ভীরমুখে অরেঞ্জ জুস খাচ্ছিল। বাপ লোকটির আঘাত বা অসুস্থতা তেমন গুরুতর বলে মনে হচ্ছিল না, এবং বাবা-মা আর বাচ্চাদের সবাইকেই খুব বোরড্ মনে হচ্ছিল।
জানালার ওপাশে বিস্তীর্ণ একটা ঘাসের আঙিনা। ¯িপ্রঙ্কলারগুলো ঘর্ঘর শব্দে ঘুরে যাচ্ছিল আর পান্নারঙ ঘাসের ওপর শাদা আলোর সিঞ্চন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। লম্বা লেজের দুটো পাখি এই দৃশ্যপট ভেদ করে উড়ে যেতে যেতে তীক্ষè স্বরে ডেকে উঠল এবং দ্রুতই দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল। লনটাতে আগে কয়েকটা টেনিস কোর্ট ছিল, কিন্তু সেগুলোর নেটগুলো ছিঁড়ে গিয়েছিল আর সেখানে কোনো জনমনিষ্যি ছিল না। টেনিস কোর্ট ছাড়িয়ে এক সারি জেলকোভা গাছ, আর সেগুলোর শাখা-প্রশাখার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। ইতস্তত ক্ষুদে ক্ষুদে ঢেউয়ের ওপর সদ্যগ্রীষ্মের উজ্জ্বল সূর্য ঝিকমিক করছিল। মৃদুমন্দ বাতাস জেলকোভার নতুন পাতায় মর্মর তুলছিল, আর খুব মৃদুভাবে ¯িপ্রঙ্কলার থেকে নির্গত কুয়াশার সারিগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছিল।
আমার মনে হলো যেন এই দৃশ্যটাই বহু আগে কোথাও দেখেছি। এই বিস্তীর্ণ ঘাসের আঙিনা, যমজকন্যাদের অরেঞ্জ জুস খাওয়া, লম্বা লেজের পাখিদের উড়ে যাওয়া, আর নেটশূন্য টেনিস কোর্টের ওপাশে নীল সমুদ্র...। কিন্তু সেটা শুধুই একটা প্রহেলিকা। সেটা খুব উজ্জ্বল আর বাস্তব বলে মনে হলেও আসলে একটা বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। আগে কখনোই আমি এই হসপিটালটায় আসি নাই।
সামনের চেয়ারটায় দুই পা তুলে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে আমি চোখ বুজলাম। গভীর অন্ধকারের ভেতর শাদা একটা পিণ্ড দেখা দিল। একটা মাইক্রোস্কোপের নিচে একটা মাইক্রোবের মতো সেটা নিঃশব্দে সংকুচিত আর প্রসারিত হতে লাগল। সেটা আকৃতি পাল্টাছিল, বিস্তৃত হচ্ছিল, টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল, আবার একটা এককে পরিণত হচ্ছিল।
আট বছর আগে আমি সেই হসপিটালটায় গিয়েছিলাম। সেটা ছিল সমুদ্রের ধারে ছোট্ট একটি হসপিটাল। সেটার ক্যাফেটোরিয়ার জানালার বাইরে শুধুই ওলিয়েন্ডারের ঝাড় দেখা যাচ্ছিল। এবং হসপিটালটা খুব পুরোনো বলে সারাক্ষণই সেটা বৃষ্টিদিনের গন্ধ ছড়াচ্ছিল। সেখানে আমার বন্ধুর বান্ধবীর বুকের অপারেশন হয়, তাই আমি এবং আমার বন্ধু তাকে দেখতে যাই। সেটা ছিল আমাদের হাইস্কুলের গ্রীষ্মকালীন ছুটির মাঝামাঝি একটা সময়।
অপারেশন বলতে তেমন জটিল কিছু নয়; তাঁরা বলেছিলের তাঁরা শুধু তার বুকের ভেতরকার সামান্য বাঁকা জন্মগত একটি হাঁড় সোজা করবেন। ওই অবস্থায় অপারেশনটা যে খুব জরুরি ছিল তা নয়, কিন্তু কোনো না কোনো সময় যেহেতু সেটা করতেই হতো, তাই তাঁরা সেটা তখনই করার সিদ্ধান্ত নেন। মূল অপারেশনটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হয়, কিন্তু প্রক্রিয়াটার পরের বেড-রেস্টটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই পরের দশটি দিন তাকে হসপিটালেই থেকে যেতে হয়। আমার বন্ধুটির ১২৫সিসি ইয়ামাহা মোটরসাইকেলে চেপে পাহাড়ি পথে আমরা সেখানে পৌঁছালাম। যাবার সময় সে চালাল, ফেরার পথে আমি চালালাম। সে-ই আমাকে তার সঙ্গে যেতে বলেছিল। “আমি আসলে একা একা কোনো হসপিটালে যেতে চাই না,” সে আমাকে বলেছিল।
আমার বন্ধুটি ট্রেন স্টেশনের সামনের একটা চকলেটের দোকানে দাঁড়িয়ে এক বাক্সো চকলেট কিনল। যাওয়ার পথে আমি একহাতে তার বেল্ট এবং আরেক হাতে চকলেটের বাক্সোটা শক্ত করে ধরে বসে রইলাম। সেটা ছিল প্রচণ্ড গরম একটা দিন, আর আমাদের গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আবার বাতাসে শুকিয়ে যাচ্ছিল। বাইক চালাতে চালাতে আমার বন্ধুটি অনির্দিষ্ট সুরে ভয়ঙ্কর, বিকৃত গলায় একটা গান গাইছিল। এখনো আমি তার ঘামের গন্ধটা মনে করতে পারি। সে মারা গেছে খুব বেশিদিন হয় নাই।
তার বান্ধবী একটা নীল পাজামার ওপর হাঁটু অবধি লম্বা পাতলা গাউনের মতো কিছু একটা পরে ছিল। আমরা তিনজন ক্যাফেটেরিয়ার একটা টেবিলে বসলাম, শর্ট হোপস টানলাম, কোলা গিললাম, আর আইসক্রিম খেলাম। মেয়েটা ছিল অসম্ভবরকম ক্ষুধার্থ এবং সে ঘন পাউডারে মোড়া দু’দুটো সুগার ডোনাট খেয়ে ফেলল, বিপুল ক্রিম দেওয়া এক মগ কোকাও খেল। তারপরও তাকে তৃপ্ত মনে হচ্ছিল না।
“হসপিটালটা ছাড়ার আগেই তুমি একটা মুটকি শূকর হয়ে যাবে,” আমার বন্ধু বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল।
“তাহলে তো ভালোই হবে। আমার তো এখন সেরে ওঠার সময়।” পেপার ন্যাপকিনে তৈলাক্ত আঙুল মুছতে মুছতে সে তড়িৎ জবাব দিল।
তারা দুজন যখন এইসব আলাপ করছিল, তখন আমি জানালা দিয়ে ওলিয়েণ্ডারের ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেগুলো এত বিশাল বিশাল ছিল যে সবগুলো মিলে প্রায় একটা অরণ্যের মতো হয়ে গিয়েছিল। আমি ঢেউয়ের শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম; উইন্ডোসিলের ওপরকার ধাতব বেষ্টনীটা লবণাক্ত বাতাসে পুরোপুরি মরিচা ধরে গিয়েছিল। ছাদ থেকে ঝুলছিল অবিকল অ্যান্টিকের মতো দেখতে একটা ফ্যান, আর সেটা ঘরের ভেতরকার আর্দ্র বাতাসটাকে মন্থন করে যাচ্ছিল। ক্যাফেটেরিয়াটা হসপিটাল-হসপিটাল গন্ধে ভরে ছিল। খাদ্য, পানীয়, সবই যেন কোনো পূর্বনির্ধারিত চুক্তি মোতাবেক ওই গন্ধটা বহন করছিল। মেয়েটির গাউনে দুটো ব্রেস্ট-পকেট ছিল, যার একটাতে একটা ছোট্ট সোনালি বলপয়েন্ট পেন গোঁজা ছিল। যখনই সে সামনে ঝুঁকছিল, আমি তার “ভি” আকৃতির নেকলাইনের ভেতর দিয়ে তার বুকের সমতল, শাদা ত্বকটা দেখতে পাচ্ছিলাম, যেখানে কখনো সূর্যের স্পর্শ লাগে নাই।
ঠিক এইখানে এসে আমার স্মৃতিটা থমকে গেল। “তারপর কী হয়েছিল?” আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। আবার এক ঢোক কোক খেয়েছিলাম, ওলিয়েন্ডারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, চকিতে একবার তার বুকের দিকে তাকিয়েছিলাম, এবং তার পরে কী? প্লাস্টিকের চেয়ারটায় বসে হাতের ওপর মাথা রেখে আরেক স্তর গভীরে আমার স্মৃতিটা খোঁড়ার চেষ্টা করলাম। পাতলা একটা ছুরির আগা দিয়ে কোনো ছিপি উপড়ে তোলার মতো।
...দৃষ্টি অস্পষ্ট করে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম ডাক্তাররা তার বুকের মাংস চিরে উন্মুক্ত করছেন, তারপর ল্যাটেক্স-মোড়া আঙুলগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে তার হাঁড়টাকে প্রতিস্থাপন করছেন। কিন্তু দৃশ্যটা খুব অবাস্তব, খুব কাল্পনিক বলে মনে হলো। একধরনের কল্পগল্পের মতো।
হ্যাঁ, তারপর আমরা সেক্স নিয়ে কথাবার্তা বলেছিলাম। আমার বন্ধুই সেটা বলছিল। এবং সে আসলে কী বলছিল? সম্ভবত সে আমার কিছু ঘটনা বলছিল; যেমন কীভাবে আমি একটা মেয়ের সঙ্গে ওইসব করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম। ওইরকমই কিছু একটা সে বলছিল। এবং যদিও মূল ঘটনাটা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না কিন্তু সে সেটা এমন অতিরঞ্জিত করে, এমন মজা করে, আর এমন হাস্যকর করে বলছিল যে তার বান্ধবী হাসিতে ফেটে পড়ছিল। আমিও না হেসে পারছিলাম না। সে সত্যিই খুব ভালো কথক ছিল।
“প্লিজ আমাকে আর হাসিও না তো,” হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, “হাসলে সত্যিই আমার বুক ব্যথা করে।”
“কোন জায়গাটায় ব্যথা করে?” আমার বন্ধু জানতে চাইল।
সে জামার ওপর দিয়ে তার বাম স্তনের একটু ভেতরে, হৃৎপিণ্ডের ওপরে, একটা আঙুল দিয়ে চাপ দিল। বন্ধুটা তখন সেটা নিয়ে আবার একটা জোক বলল, এবং আবার সে হেসে উঠল।
আমি আমার ঘড়ির দিকে তাকালাম। এগারোটা পয়তাল্লিশ, এবং আমার কাজিন এখনো ফেরে নাই। লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে, ক্যাফেটেরিয়াটা লোকজনে ভরে উঠতে শুরু করেছে। নানারকম শব্দ আর টুকরো কথাবার্তা মিশে ঘরটাকে সিগ্রেটের ধোঁয়ার মতো ঢেকে ফেলছে।
আমি আবার স্মৃতির রাজ্যে ফিরে এলাম। তার বুকপকেটের সোনালি বলপয়েন্ট পেনটার কথা ভাবতে লাগলাম।
...হ্যাঁ। ওই বলপয়েন্টটা দিয়েই সে একটা পেপার ন্যাপকিনের উল্টোদিকে কিছু একটা আঁকছিল।
সে একটা ছবি আঁকছিল। ন্যাপকিনটা ছিল খুবই ভঙ্গুর, আর তার পেনের আগাটা বারবার সেখানে আটকে যাচ্ছিল। কিন্তু সে খুব ধৈর্য্য নিয়ে একটা পাহাড় আঁকল। পাহাড়ের চূড়ায় ছোট্ট একটা বাড়ি। সেই বাড়িটার মধ্যে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে ছিল। বাড়িটার চারদিকে ঘন অন্ধ উইলো থিকথিক করছিল। অন্ধ উইলোই মেয়েটিকে ওইরকম ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল।
“অন্ধ উইলো জিনিসটা কী?” আমার বন্ধুটি জানতে চাইল।
“একটা গাছের নাম।”
“ও, আগে শুনিনি তো।”
“শোনোনি কারণ আমিই এটা বানিয়েছি।” একটু হেসে সে জানাল। “অন্ধ উইলোর প্রচুর পরাগ; ক্ষুদে ক্ষুদে মাছিগুলো এই পরাগ নিয়ে তার কানের ভেতরে গিয়ে ঢোকে, আর এটাই তাকে এরকম ঘুম পাড়িয়ে দেয়।”
সে নতুন একটা ন্যাপকিন নিয়ে অন্ধ উইলোর একটা স্কেচ আঁকল। ঠিক একটা এজালিয়া ঝোপের আকৃতির। গাছটায় ফুল ছিল, আর ফুলগুলো মোটা মোটা সবুজ পাতায় পুরোপুরি ঢেকে ছিল, সেগুলোকে টিকটিকির ল্যাজের ঘনগুচ্ছের মতো লাগছিল। উইলোর সঙ্গে অন্ধ উইলোর একটুও মিল ছিল না।
“সিগ্রেট আছে?” আমার বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমি একটা লাইটার আর ঘামে-ভেজা সর্ট হোপসের একটা প্যাকেট তার দিকে ছুড়ে দিলাম।
“অন্ধ উইলো দেখতে ছোট লাগে, কিন্তু এর শেকড় অসম্ভব গভীর,” তার বান্ধবী বোঝাচ্ছিল। “আসলে একটা বয়সে পৌঁছে অন্ধ উইলো আর ওপরদিকে বাড়ে না, নিচের দিকে, মাটির আরো গভীরে বাড়তে থাকে। যেন অন্ধকার থেকেই পুষ্টি টেনে নিতে থাকে।”
“এবং আসলে, মাছিগুলো এর পরাগ নিয়ে গিয়ে তার কানের ভেতরে গর্ত করে, আর সেজন্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ে,” আর্দ্র সিগ্রেটটাতে আগুন ধরানোর চেষ্টা করতে করতে আমার বন্ধুটি আবার বলল। “আর তারপর... তারপর মাছিগুলো কী করে?”
“তারপর মাছিগুলো তার মাংস খেতে থাকে, তার শরীরের গভীরের মাংস,” তার বান্ধবী বলল।
“চিবিয়ে চিবিয়ে,” আমার বন্ধু যোগ করল।
আমার মনে পড়ছে ওই গ্রীষ্মে সে অন্ধ উইলো নিয়ে একটা লম্বা কবিতা লিখেছিল, আর এর আখ্যানের রূপরেখাটা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছিল। গ্রীষ্মের ছুটিতে এটাই ছিল তার একমাত্র হোমওয়ার্ক। একরাত্রে দেখা একটা স্বপ্নকে কেন্দ্র করে সে এই গল্পটা বানায়, আর পরের সপ্তায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে এটা লিখে ফেলে। আমার বন্ধুটি সেটা পড়তে চায়, কিন্তু সে সেটা দেয় না, বলে যে এখনো সেটা পুরো লেখা হয় নাই। তার বদলে সে ছবি এঁকে এর আখ্যানটা ব্যাখ্যা করে।
অন্ধ উইলোর-ঘুম-পাড়ানো-মেয়েটিকে উদ্ধার করতে একদিন এক যুবক সেই পাহাড়টা বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
“সেই যুবকটাই হলাম আমি, শিওর,” আমার বন্ধুটি লাফিয়ে উঠল।
তার বান্ধবী মাথা নাড়ল, “না, সেই যুবকটা তুমি নও।”
“এবং তুমি সেটা জানো?” আমার বন্ধু বলল।
“হ্যাঁ, আমি জানি,” সিরিয়াস মুখ করে সে জবাব দিল। “কীভাবে জানি তা জানি না, কিন্তু ব্যাপারটা এরকমই। তুমি কি কষ্ট পেলে?”
“অবশ্যই,” আমার বন্ধু একটু তামাশা করে ভ্রƒকুটি করল।
অতিবর্ধিষ্ণু আর অভেদ্য এই অন্ধ উইলো সারাক্ষণ ঠেলে ঠেলে সরিয়ে সরিয়ে পথ বানিয়ে বানিয়ে সেই যুবকটি ধীরে ধীরে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল। আসলে পাহাড়টা অন্ধ উইলোতে এতই ভরে গিয়েছিল যে সে-ই প্রথম লোক যে ওই পাহাড়ে ওঠার উদ্যোগ নেয়। চোখের ওপর হ্যাটের ভাইজারটা নামিয়ে, সারাক্ষণ ভনভনে মাছি সরাতে সরাতে যুবকটি একপা একপা করে ওপরে উঠতে লাগল। ঘুমন্ত মেয়েটিকে মুখোমুখি দেখার জন্যে। গভীর, নিঃসীম ঘুম থেকে তাকে জাগিয়ে তোলার জন্যে।
“কিন্তু অবশেষে সে পাহাড়টার চূড়ায় পৌঁছে দেখল যে মাছিগুলো ইতিমধ্যে তাকে খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে, তাই তো?” আমার বন্ধু বলে উঠল।
“এক অর্থে, তা-ই।” সে উত্তর দিল।
“তাহলে, তার যদি তা-ই হয়ে থাকে, মাছিগুলো যদি তাকে একদম সাবাড় করেই দিয়ে থাকে, এক অর্থে, এটা কি একটা নৈরাশ্যকর গল্প নয়?” আমার বন্ধুটি ঘোষণা করল।
“হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।” একটু চিন্তা করে সে বলল। “তোমার কী মনে হয়?” মেয়েটি এবার আমাকে জিজ্ঞেস করল।
“আমার কাছেও এটা একটা নৈরাশ্যকর গল্প বলেই মনে হচ্ছে।” আমি উত্তর দিলাম।
১২:২০-এর দিকে আমার কাজিন বেরিয়ে এল। তার চোখেমুখে বিহ্বল একটা ভাব, আর তার আঙুলে ঝুলন্ত একটা ওষুধের ঝোলা। ক্যাফেটেরিয়ার প্রবেশমুখে আবির্ভূত হয়ে আমার টেবিলটা খুঁজে পেতে তার খানিকক্ষণ সময় লাগল। সে একটু এলোমেলোভাবে হাঁটছিল, যেন তার ভারসাম্য ধরে রাখতে কোনো সমস্যা হচ্ছে। সে আমার উল্টোদিকের সিটে ধপাস করে বসল, এবং যেন এতক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলারই ফুসরত পায়নি এমনভাবে বিরাট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
“কী অবস্থা?” আমি জানতে চাইলাম।
“হুঁ,” সে বলল। সে আরও কিছু বলবে ভেবে আমি চুপ করে রইলাম, কিন্তু সময় গড়াতে লাগল আর সে চুপ করেই রইল।
“তুমি কি ক্ষুধার্থ?” আমি বললাম।
আমার কাজিন নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
“তুমি কি এখানেই খাবে নাকি বাসে করে শহরের অন্য কোথাও গিয়ে খাবে? কোনটা?”
অনিশ্চিতভাবে সে রুমটার চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর বলল যে এখানেই খাওয়া যায়। আমি কয়েকটা মিল টিকেট কিনে দুইটা লাঞ্চের অর্ডার দিলাম। খাবার না আসা পর্যন্ত আমার কাজিন নিঃশব্দে জানালা দিয়ে একটু আগে আমি যে দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম সেই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে রইল... সেই সমুদ্র, সেই জেলকোভা গাছের সারি, সেই ¯িপ্রঙ্কলার।
পাশের টেবিলে পরিপাটি একটা মধ্যবয়সী দম্পতি স্যাণ্ডউইচ খেতে খেতে হসপিটালে ভর্তি হওয়া লাঙ-ক্যান্সারে আক্রান্ত তাদের কোনো বন্ধুকে নিয়ে আলাপ করছিল। তারা বলছিল যে বছর পাঁচেক হলো সেই লোক সিগ্রেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু তদ্দিনে তার অনেক দেরি হয়ে গেছে, এবং একদিন সকালে সে কিরকম রক্তকাশি কাশতে কাশতে ঘুম থেকে জেগে উঠল। বউটা প্রশ্ন করছিল, আর স্বামীটা সেসবের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। “এক অর্থে,” স্বামীটা বোঝাচ্ছিল, “কোনো লোকের ক্যান্সারের মধ্যে দিয়ে তুমি তার সমগ্র জীবনটাকে দেখে নিতে পারো।”
লাঞ্চে ছিল হামবুর্গ স্টেক আর ফ্রায়েড হোয়াইট ফিস। সালাদ আর রোলও ছিল। আমরা নিঃশব্দে মুখোমুখি বসে খেতে লাগলাম। আমাদের খাওয়ার পুরো সময়টা পাশের টেবিলের দম্পতি ক্যান্সারের উৎস নিয়ে মগ্ন আলোচনাটা চালিয়ে গেল। বয়স্কদের ক্যান্সারের হার কেন বেড়ে গেছে, কেন তাঁরা কোনো আশ্চর্য ওষুধ আবিষ্কার করতে পারছেন না, এইসব।
“যেখানেই যাও, ওই একই ব্যাপার,” নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হতাশ কণ্ঠে আমার কাজিন বলল। “সবাই ওই একই ধরনের প্রশ্ন করবে, আর একইভাবে আমার কান পরীক্ষা করবে।”
আমরা হসপিটালের গেটের কাছে একটা বেঞ্চের ওপর বসে ছিলাম। মাঝে মাঝেই হাওয়া এসে আমাদের মাথার ওপরের সবুজ পাতায় মর্মর তুলছিল।
“তুমি কি মাঝে মাঝে একদমই শুনতে পাও না?” আমি বললাম।
“হ্যাঁ,” �