করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





মানিপ্ল্যান্টের খোঁজে (দ্বিতীয় অংশ)
ফয়জুল ইসলাম
শিহাবের সাথে আর থাকতে না-পারা বিষয়ক টুম্পার ঘোষণাটা যে সত্যি ছিল তা পরদিন অফিস থেকে ফেরার পরে বোঝা যায়। লিভিং রুমের টেবিলে পড়ে আছে টুম্পার লিখা চিরকুট: আমি আর নাবিল লেকসার্কাস যাচ্ছি। আব্বা-আম্মার সাথে কয়েকদিন থাকব। টুম্পার চিরকুট পড়ে শিহাবের প্রথমত তার প্রতিক্রিয়া হয় যে নাবিলের সাথে কবে তার দেখা হবে তা ঠিক পরিষ্কার নয় কেননা সে লেকসার্কাসে টুম্পাদের বাসায় যাবে না কিছুতেই। দ্বিতীয়ত, সে অনুধাবন করে যে নাবিল-ভিন্ন এবাসায় একা থাকার কোনো প্রস্তুতিই নাই তার। আর তাছাড়া ব্যক্তিগত লেনদেন না-থাকলেও এবাসায় মানিপ্ল্যান্টের মৃত্যু সংক্রান্ত তার প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ বিষাদ এবং অভিযোগ প্রকাশের একমাত্র মানুষ ছিল টুম্পা। সেই টুম্পাটাও অনুপস্থিত। টুম্পা বাসায় থাকবে না, এই পরিস্থিতির জন্যও সে প্রস্তুত নয় আদৌ। কিন্তু টুম্পাকে বাসায় ফিরে আসার জন্য তো আর তোয়াজ করা যায় না! মানিপ্ল্যান্টটা মরে গেছে বলে মেয়েটা যথেষ্ট মনখারাপ করলেও আশ্চর্য যে মেয়েটা এখনো মনে করে, একটা গাছ তো মরে যেতেই পারে এবং সেজন্য যুথিকে দোষী করাটা অন্যায়!
তবুও সেই হাস্যোজ্জ্বল টুম্পার মুখ তার মনে পড়ে। শিহাব খামারবাড়িতে অফিস করে, অফিস থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সে আব্বা-আম্মার সাথে দেখা করতে শংকর যায় এবং জিগাতলার বাসায় ফেরার পথে সে সিটি কাফে-তে বন্ধুদের আড্ডায় থামে। সবখানেই তার অস্তিত্বের খুব গভীরে চুপ করে বসে থাকে টুম্পা। তখন বারবার তার স্মৃতিতে আসে-যায় লেকসার্কাসের কোনো একটা একতলা বাসা। আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে সেবাসাতে তাকে নিয়ে বেড়াতে যায় তার বন্ধু মিলু। মিলু সেমুহূর্তে নেওয়াজ নামের তার প্রিয় সহপাঠীর সাথে শীতলক্ষ্যায় নৌকাভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাজেই সেই বাসার ছাই রঙের পুরনো সোফায় চুপচাপ বসে এদিক-ওদিক তাকানো ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না শিহাবের। একটু দূরে একটা সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে তখন পা দুলাতে থাকে শ্যামলবরণ পাতলাসাতলা অপরূপ এক মেয়ে, তার বয়স হবে বছর পঁচিশ, তার পরনে মেরুন সালওয়ার-কামিজ আর সাদা ওড়না। তেত্রিশ বছরের সরকারি চাকুরে শিহাব লক্ষ করে দেখে, মেয়েটার চেহারা নেওয়াজের চেহারার সমিল। হয়ত মেয়েটা নেওয়াজের ছোটো বোনই হবে। মিলু আর নেওয়াজ নৌকাভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে এতই ডুবে থাকে যে শিহাবের সাথে মেয়েটার পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা ভুলেই যায় তারা। নিওনের উজ্জ্বল আলোতে সেই মেয়েটার মুখের বামপাশটা কেবল স্পষ্ট দেখতে পায় শিহাব, ঈষৎ বাদামি চুলের ঢেউ, টানা ভুরুর অংশ, চোখের সাদা প্রচ্ছদ, টিকলো নাক, পাতলা ঠোঁটের একপাশ, ডিম্বাকৃতির থুতনি। মেয়েটার রূপ চুরি করে দেখে নিয়ে শিহাব মনোযোগ নিবদ্ধ করে থাকে মিলু আর মিলুর সহপাঠী নেওয়াজের দিকে। একপর্যায়ে নেওয়াজ আশ্চর্য হয় যেহেতু উনিভার্সিটিতে পড়ার সময় শিহাবকে সে কোনোদিন দেখেই নাই! মৃদু হেসে শিহাব উত্তর দেয় যে আসলে কার্জন হল থেকে খুব একটা আর্টস ফ্যাকাল্টিতে যাওয়া পড়ত না তার। নেওয়াজ মন্তব্য করে: কার্জন হলে আমি বহুত আড্ডা মারতে গেছি! আপনেরে দেখি নাই। আপনে মিয়া চুপচাপ টাইপের আদমি বইলা বুঝা যাইতেছে!   
নেওয়াজের মন্তব্য মাটিতে পড়ার আগেই মিলু বলে ওঠে: চুপচাপ থাকলে কি হইব? এইডা মিচকা শয়তান! তারপর মিলু আর নেওয়াজ উচ্চগ্রামে হেসে ওঠে। মিলু আর নেওয়াজ পুনরায় নৌভ্রমণ বিষয়ক আলাপে ফিরে গেলে আর কোনো কাজ না-পেয়ে ফের ঘরটার এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করে শিহাব। টুম্পার দিকে চোখ পড়লে সে দেখতে পায়, উচ্ছ্লতা আর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে গভীর দু’টো চোখ। সেই দু’চোখে আটকে যায় বিস্মিত শিহাব সেকেন্ড পাঁচেক। তার কেন যেন মনে হয়, এই দু’চোখ তার অনেকদিনের চেনা! কোথায় সে দেখেছে এ গভীর চোখ? দু’জনের চোখের সেই সম্মিলন লক্ষ করে না মিলু অথবা নেওয়াজ। তারপর যেন কিছুই ঘটেনি, এমন একটা ভাব নিয়ে মেয়েটা শিহাবের চোখ থেকে তার চোখ সরিয়ে নিয়ে ফের টিভি দেখতে থাকে। মিলু আর নেওয়াজের দিকে শিহাবের চোখ ফিরে যায় তখন। লেকসার্কাসের সেই বাসায়, যেই বাসার সামনের মাঠে একদা হলুদ গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা আর বড় বড় ডালিয়ার ঝাড় ছিল, সেই বাসায় এভাবে খুব নীরবে প্রিয়তম পাতার সাথে শিহাবের প্রথম দেখা হয়।
তার প্রায় মাস দুয়েক পরের এক সকালে শিহাবের অফিসের ল্যান্ড লাইনে ফোন আসে টুম্পার: চিনছেন আমাকে? আমি লেকসার্কাসের নেওয়াজের ছোটো বোন। শিহাব ভীষণ অবাক হয় কেননা তার ফোন নম্বর তো নেওয়াজের বোনের জানার কথা নয়! টুম্পা তাকে জানায় যে সেদিন শিহাবরা চলে যাওয়ার পরে বসার ঘরের টেবিলে শিহাবের একটা নেইম কার্ড পড়ে ছিল। সেই নেইম কার্ড থেকেই শিহাবের ফোন নম্বর পায় টুম্পা। টুম্পা তাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করে: আপনের অফিসে কি একটু আসব? উচ্ছ্ল আর অনুসন্ধিৎসু সেই দু’চোখ আবারো দেখার লোভে সাথে সাথেই হ্যাঁ বলে দেয় শিহাব। আড়ং-এ কাজ সেরে টুম্পা তার অফিসে আসে। তারা গল্প করে অবিরত। বাইরে লাঞ্চ করবে বলে হাঁটতে হাঁটতে তারা মণিপুরি পাড়ার দিকে আগায়। দীর্ঘাঙ্গী টুম্পার রেশমসম বাদামি চুল অনেক হাওয়াতে উড়তে থাকে তখন। তার হাঁটার ছন্দে হাজার বছরের কুহকের হাতছানি। তার কন্ঠাস্থির সম্মিলনে ছোট্ট একটা কাল তিলে জমা হয় সূর্যের চাইতেও বেশি উজ্জ্বলতা। মুগ্ধ হয়ে টুম্পার দিকে তাকিয়ে থাকে শিহাব। মণিপুরি পাড়ার কোনো একটা রেস্টুরেন্টে সেদিন তারা লাঞ্চ খায়।
পরের দিনগুলোতে পরস্পরের সহজ আচরণ দেখে চমৎকৃত হয় তারা এবং ঘুরেফিরেই তারা দুঃখ করতে থাকে—ইস! কেন আরো দশ বছর আগে আমাদের দেখা হল না!  একই শহরেই তো বড় হলাম আমরা দু’জন! সেই প্রশ্নের কোনো মীমাংসা না-হলেও কিছু যায় আসে না তাদের। টুম্পা ক্রমশ ভুলে যায় নিজেদের মহল্লার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমিক প্রবরদের অবিরত টোকাগুলো। আর প্রেম হ’ল না বলে দীর্ঘদিনের হা-হুতাশ বন্ধ হয়ে যায় শিহাবের। প্রায় প্রায়ই শিহাব অফিস ফাঁকি দিয়ে অথবা অফিসের পরে বিকালবেলায় দেখা করে টুম্পার সাথে এই শহরের কোথাও না কোথাও। ফেলে আসা সেসব চটপটি-ফুচকার দিন, রিকশার দিন, অজগ্র জারুলের দিন, বৃষ্টি অথবা শৈত্যের দিন সংসদ ভবন এলাকায়, রমনা পার্কে, ধানমণ্ডির পথে পথে অথবা লেকের ধারে অথবা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, আজ খুব মনে পড়ে শিহাবের। সেই টুম্পা এখন মেজাজ খারাপ করে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো মমতাহীন কাজও করতে পারে! কী আশ্চর্য! ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে এসব অভিযোগ-অনুযোগ তুলে শিহাব স্তম্ভিত হয় কেননা বন্ধুরা তাকে উল্টো জাঁতা দেয়: এই এক মানিপ্ল্যান্ট নিয়া তুমি কম ঝামেলা কর নাই! টুম্পা চইলা গেছে, ঠিক করছে!
শিহাবের ওপরে রাগে, অভিমানে টুম্পার লেকসার্কাস চলে যাওয়ার পরদিন থেকেই বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় শিহাবের প্রাত্যহিকতা। অফিস সেরে বাসায় ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সে বারান্দার টবে রাখা গাছগুলোতে পানি দেয়। তারপর জিগাতলা পোস্ট অফিস থেকে হাঁটতে হাঁটতে সাত মসজিদ রোড দিয়ে সে ধানমন্ডি লেকে ঢোকে এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকে লেকের দক্ষিণের নির্জন এলাকায়, এয়ার গান দিয়ে বেলুন ফুটায়, চা-বিড়ি খায়, ফাও ফাও বসে থাকে কোথাও। তারপর সে শংকরমোড়ের সিটি কাফেতে যায় যেখানে জড় হয় তার ধানমন্ডি এলাকার বন্ধুরা। তবে আব্বা-আম্মার সাথে আর প্রতিদিন দেখা করতে যেতে ভাল লাগে না তার কেননা তার কাল মুখ করে ঘুরে বেড়ানোর কারণ জানার চেষ্টায় আম্মা অন্তত দু’তিনটা প্রশ্ন করবেই। তার চাইতে প্রতিদিন আম্মাকে ফোন করা ভাল: খুবই ব্যস্ততা যাইতেছে আম্মা! বাসায় যাওয়ার টাইমই পাইতেছি না! আড্ডা দিয়ে রাত এগারটার আগেই তাকে জিগাতলার ভাড়া বাসায় ফিরতে হয় যেহেতু ঠিক তখনই বাসাটার মেইন গেটটা বন্ধ করে দেয়া হয়। বাসায় ফিরে তার আর কিছু রান্না করে খেতে ইচ্ছা করে না। ফেরার পথে, মিলু বা মামুন বা রোকন খুব করে ডাকলে, সে কখনো তাদের বাসায় রাতের খাবার খায়, না-হলে সে শংকর অথবা জিগাতলা এলাকার কোনো হোটেলে খেয়ে নেয় অথবা কিনে আনে কলা আর পাউরুটি।
এভাবে পার হয় নয়-নয়টা দিন। টুম্পা অথবা শিহাব কেউ কাউকে ফোন করে না। বন্ধুদের সমালোচনায় শিহাবের অহমিকা পা পিছলিয়ে পড়ে যেতে থাকে তখন। শংকরমোড়ের আড্ডায় একদিন মিলু তাকে জানায়: টুম্পার সাথে ফোনে কথা হইল। টুম্পাই ফোন দিছিল। তর ওপরে অভিমান কইরা কান্নাকাটি করল। বন্ধুদের হয়ে মিলু তখন তাকে অনুরোধ করে: তুই গিয়া ওরে নিয়া আয়। তুই আল্লার ওয়াস্তে মানিপ্ল্যান্ট নিয়া ফালতু ঝগড়াঝাটি বন্ধ কর! আর তখন মিলুর কথায় দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে টুম্পার ওপরে শিহাবের যত রাগ আর অভিমান।  টুম্পা এবং নাবিলের অভাবে বাসাটায় শিহাবের খুব ফাঁকা ফাঁকাও লাগতে শুরু করে।
একরাতে শিহাবের বন্ধু ইমতি তাকে ফোনে জানায় যে দু’দিন আগে ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ যুদ্ধে হেরে গিয়ে মারা গেছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি আনিস। সাতচল্লিশ বছর বয়সি শিহাবের মনে হতে থাকে, যদি আজ রাতেই তার হার্ট অ্যাটাক হয়, যদি সে আর কালকের সকালটা দেখতে না-পায়, তা’হলে তো ছোট্ট নাবিলের গায়ের সুন্দর গন্ধটা সে আর নিতে পারবে না কোনোদিন, তাহলে তো টুম্পাকে সে আর বলতে পারবে না কোনোদিন যে টুম্পার উজ্জ্বল দু’চোখ এখনো তাকে উজবুক করে দেয়, এখনো তাকে মাতাল করে টুম্পার পাতলা ঠোঁট অথবা টুম্পার দুই কন্ঠাস্থির ফাঁকের ছোটো কাল তিলটাকে নিয়ে এখনো সে চিন্তা করে কবিতা লিখার কথা। কাজেই টুম্পা এবং নাবিলের কলাবাগান চলে যাওয়ার দশম রাতে শিহাব অস্থির হয়ে টুম্পাকে মোবাইল ফোনে টেক্সট ম্যাসেজ পাঠায়: তোমার দেয়া মানিপ্ল্যান্টটা মইরা গেছে, যাক! আমরা আর একটা মানিপ্ল্যান্ট লাগাব। তুমি ফিরা আস জলদি। কিন্তু সেই টেক্সট ম্যাসেজের কোনো উত্তর দেয় না টুম্পা বা ফোনও করে না। তা’তে অভিমান আর অস্থিরতা আরো বেড়ে যায় শিহাবের। টুম্পা নিশ্চয় এখনো তার ওপরে বিরক্ত। তা হতেই পারে! কিন্তু তাই বলে কি টেক্সট ম্যাসেজের উত্তর দেয়া যাবে না? অবশ্যই এটা টুম্পার অন্যায় কাজ! এই ভেবে সে সহজে টুম্পাকে আর ফোন করবে না বলে পণ করে।
নাবিলকে সাথে নিয়ে টুম্পা কলাবাগান চলে যাওয়ার ত্রয়োদশ দিনে অফিস থেকে শিহাব সোজা শংকরে আম্মার ওখানে যায়। গোসল করে টেবিলে খেতে বসলে তার পাশে বসে এটা-ওটা গল্প করে আম্মা এবং একপর্যায়ে শিহাবকে জাজ্ঞাসা করে: কিরে! টুম্পা আর নাবিলরে আনস না কেন? কতদিন দেখি না ওগো! ‘আচ্ছা! নিয়া আসুমনে!’ বলে সে তার আর টুম্পার মনোমালিন্যের ব্যাপারটা আম্মার কাছে বেমালুম চেপে যায়। সিটি কাফে-তে যথারীতি আড্ডা দিয়ে রাত সোয়া নয়টার দিকে জিগাতলার বাসার গেট দিয়ে ঢোকার মুখে সে তাদের দোতলার ঘরগুলোতে আলো জ্বলতে দেখে। তার অর্থ, ফিরে এসেছে টুম্পা! উত্তেজনায় বেড়ে যায় শিহাবের হৃদপিণ্ডের ধুকধুকানি। দোতলায় উঠে বেল টিপলে ছোট্টো নাবিল দরজা খুলে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে যায় বসার ঘরে। নিউ মার্কেট থেকে কেনা পোস্টার কালারগুলো তার বাবাকে দেখাতে থাকে নাবিল। তখন নাবিলের উত্তেজনা পর্যবসিত হয় ছবি আঁকার খাতা আর তুলি পর্যন্ত। বাবা ছেলের পাশে বসে বসে ছবি আঁকা দেখে। কিন্তু আজ ছেলের সৃষ্টিশীলতার দিকে শিহাবের মন নাই কেননা সে অপেক্ষা করতে থাকে, কখন সামনে এসে দাঁড়াবে টুম্পা , সরাসরি অথবা কোনো ছলছুতায়। সময় যায় কিন্তু টুম্পা আসে না। তার নাকে এসে লাগে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, পোড়া তেল আর কষানো মশলার গন্ধ। অর্থাৎ টুম্পা অনেকদিন পরে ডিম অথবা মাছের দো’পেঁয়াজা রান্না করছে। প্রায় সপ্তাহ তিনেক মতো কখনো রুটি-কলা কখনোবা শংকর এবং জিগাতলার হোটেলগুলোতে খেতে খেতে ক্লান্ত শিহাব সেই সুগন্ধে নড়েচড়ে বসে, তার ভেতরে লালচ ঘূর্ণী পাকায়। লালচকে দাবাতেই হয় কেননা টুম্পার মতিগতি এই এতদিন পরে তার অজানা, মেয়েটা তার সাথে মীমাংসা করবে কি না সেটাও তার কাছে অস্পষ্ট। কাপড় ছেড়ে সে বসার ঘরের সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভিতে হাতাপাতা অনুষ্ঠানে চোখ রাখে, তবে কিছুই সে দেখে না মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু টুম্পা তার কাছে আসে না।
জিগতলার সেই বাসাটায় রাত দশটা বাজলে নাবিল নুডলস খায়, খেয়েদেয়ে সে দাঁত মাজে।  ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে তার বাবাকে বলে যায়: মা বলছে খেয়ে নিতে। টেবিলে খানা ঢেকে রাখছে মা। তারপর বাসাটার দু’নম্বর ঘরে ঘুমাতে চলে যায় নাবিল। আজো তাকে ঘুমাতে সাহায্য করে তার মা কেননা বাবা টিভি দেখতে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ পরে সোফা থেকে উঠে শিহাব ডাইনিং স্পেসে গিয়ে একটা সাগরকলা আর একগ্লাস পানি খায়। টেবিলে ঢেকে রাখা তার প্রিয় ডিম ভুনা আর ঘন ডাল দিয়ে ভাত খেতে খুব সংকোচ হয় তার। আবার সোফায় শুয়ে সে চ্যানেল পাল্টাতে থাকে খামাখাই এবং ঝিমাতে থাকে সারা দিনের অনেক ক্লান্তি নিয়ে। ঝিমাতে ঝিমাতে একটা সময় সে ঘুমিয়েই যায়। তার ঘুম ভাঙ্গে রাত যখন প্রায় একটা। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট খেয়ে সে টুম্পার কাছে যাওয়ার শক্তি সঞ্চয় করে। তাদের শোয়ার ঘরের বিছানার ধারে মাথা নিচু করে স্থিতি জড়তায় বসে থাকে শিহাব। টুম্পাকে  কি বলবে আর কি না-বলবে তা সে বুঝতে পারে না কিছুতেই এবং সে তখন মরীয়া হয়ে খুঁজতে থাকে মেয়েটাকে বলা যায় এমন যথাযোগ্য কোনো কথা যে কথায় অন্তত তেতে উঠবে না টুম্পা। দক্ষিণের দেয়ালের সাথে লাগানো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাদা সালওয়ার-কামিজ পরা নিশ্চুপ টুম্পা তখন নিজের চুল বাঁধে সযতেœ। আয়নার দিকে একটু চুরি করে তাকায় শিহাব এবং সে টুম্পার চোখে সহজাত উচ্ছ্লতা খুঁজতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু পেছন থেকে আর দেখা যায় না টুম্পার দু’চোখ। চুল বেঁধে নিয়ে বিছানায় শিহাবের পাশে এসে বসে টুম্পা। শিহাবের বাম হাতের আঙুলগুলো নিজের হাতের ভেতরে নিয়ে খেলতে খেলতে শিহাবকে প্রশ্ন করে তার প্রিয়তম পাতা: একটা ফোনও করলা না তুমি!
শিহাবও অনুযোগ করতে ছাড়ে না: ও, তাই? তুমি আমার টেক্সট ম্যাসেজের উত্তর দিছিলা?
আমি তো রাগ কইরা বাসা থেইকা বাইর হইয়া গেছিলাম! আমি ক্যান তোমারে ফোন করব? কোন দুঃখে তোমার টেক্সট ম্যাসেজের উত্তর দিব?
তুমি আর কখনো আমারে ফালায়া চইলা যাইও না টুম্পা! আমি অস্থির হইয়া যাব, আমার ঘুম হইব না, তুমি তো তা জানতা!  জানতা না?
আমারও ঘুম হয় নাই সোনা!  এই কয়দিন আমার খুব ভয় লাগছে, যদি তুমি সত্যিই রাগ কইরা আমারে ফালায়া কোথাও চইলা যাও!
পাগল হইছ তুমি? আমাদের মানিপ্ল্যান্টটা মইরা গেছে, যে কারণেই হোক না কেন। আমার আর কোনো আক্ষেপ নাই সেইটা নিয়া। তুমি ফিরা আসছ, সেইটাই বড় কথা। আমার আর কিছু লাগবে না।
কিন্তু আমার লাগবে। চল, ওই গাছটার মতোই আর একটা গাছ খুঁজি আমরা। কোথাও না কোথাও ঠিকই খুঁইজা পাওয়া যাবে, দেইখ তুমি!
তুমি আবার আমার মতো কইরা মানিপ্ল্যান্ট নিয়া পড়লা?  ধুর! বাদ দেও তো! লাগব না এইসব! নতুন একটা মানিপ্ল্যান্ট কিন্না আনুমনে।
বাদ দেয়া যাইব না। যুদ্ধ কইর না, কইলাম কিন্তু!
তো যুদ্ধ বন্ধ করে শিহাব। বস্তুত সে আর কোনো কথা খুঁজেও পায় না। টুম্পার সাথে দিনবিশেকের যুদ্ধে তৈরি হয়েছে দুস্তর অসহজতা যা এই মুহূর্তে সত্যিই অনতিক্রম্য! টুম্পা তখন তার কোলের ওপরে উঠে মুখোমুখি বসে। টুম্পার গভীর চোখে ছড়িয়ে যায় মৃদু অথচ উজ্জ্বল হাসি আগের মতোই। এই হাসি শিহাবের জন্মজন্মান্তরের চেনা। সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, টুম্পা একলহমায় অধিকার করে নেয় তার ঠোঁট এবং সেখানে হামলা চালায় অজস্র, অক্লান্ত চুম্বন, কোনোটা আদরের, কোনোটা বা কামনার। আর তারপর শিহাব ক্রমান্বয়ে ভেসে যেতে থাকে টুম্পার প্রবল আধিপত্যের ভেতরে। উত্তেজনার শেষে ঘুম নামে শ্রান্ত শরীরে তাদের এবং টুম্পাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমিয়ে যায় আগের দিনগুলোর মতোই।

পরদিন শুক্রবার ঘুম থেকে উঠে টুম্পা আর শিহাব পারাঠা আর বুটের ডাল বানিয়ে নাশতা করে অনেক অনেক দিন বাদে। নাবিল যথারীতি খায় নুতেল্লা মাখানো পাউরুটি। সেই সকালে নাবিলকে শংকরে তার দাদা-দাদির বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারা রিকশা নিয়ে তাদের মরে যাওয়া মানিপ্ল্যান্টটার মতো আর একটা মানিপ্ল্যান্ট খুঁজতে বের হয়। এই শহরের সাত মসজিদ রোড, ধানমন্ডি, মিরপুর রোড আর নিউমার্কেট এলাকার এক নার্সারি থেকে আরেক নার্সারিতে ছুটে বেড়ায় তারা। অনেক সুন্দর সুন্দর মানিপ্ল্যান্ট চোখে পড়ে সেসব নার্সারিতে, কোনোটার পাতারা বড়, কোনোটার পাতারা মাঝারি, কোনোটার বা ছোটো ছোটো পাতা। কোনোটার পাতা হালকা সবুজ, কোনোটার পাতা গাঢ়। কোনোটাতে সবুজের ওপরে গাঢ় হলুদ ছোপ, কোনোটাতে হালকা হলুদ, কোনোটাতে আবার সাদা সাদা ছোপ দেয়া। কিন্তু মৃত মানিপ্ল্যান্টের সমিল কোনো মানিপ্ল্যান্ট সেসব নার্সারিতে মেলে না। সেরকম ছোটো  ছোটো   পাতা, পাতলাসাতলা লতাগুচ্ছ, পাতাদের হালকা সবুজ রঙ, সবুজের ওপরে হালকা হলুদ ছোপের বিস্তার মেলে না সেখানের কোথাও। চৈত্রের রোদে ঘুরেঘুরে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে তারা বিছানায় ঢলে পড়ে এবং তারা ঘুমিয়ে যায় অবেলায়।   
এভাবে এশহরের অন্যান্য সব এলাকা, এই যেমন গুলশান অথবা রামপুরা অথবা উত্তরার নার্সারিগুলোতে মৃত মানিপ্ল্যান্টের সমিল কোনো মানিপ্ল্যান্ট খুঁজতে খুঁজতে কেটে যায় বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম, গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা। টুম্পা আর শিহাব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে, মৃত মানিপ্ল্যান্টের ছায়া এই শহরের সর্বত্র অনুপস্থিত! ব্যর্থতা আর ক্লান্তি নিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে যায় তারা। তখন বিষাদগ্রস্ত টুম্পাকে শিহাব কোনোদিন বলে যে এই মানিপ্ল্যান্টটা নিশ্চয় দুষ্প্রাপ্য গোত্রের গাছই হবে! তা না-হলে তো কোথাও না কোথাও ঠিকই খুঁজে পাওয়া যেত তেমন একটা গাছ! বহুত তো খোঁজা হ’ল! তাই শিহাব মেয়েটাকে আবারো প্রস্তাব দেয়, এবার খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে নতুন একটা মানিপ্ল্যান্ট কেনার কথা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু শিহাবের প্রস্তাব গ্রহণ করে না টুম্পা। শিহাবকে সাথে নিয়ে টুম্পা তাদের মৃত মানিপ্ল্যান্টের সমিল কোনো মানিপ্ল্যান্টের খোঁজে হন্যে হয়েই ঘুরে বেড়ায় এশহরের এক নার্সারি থেকে আরেক নার্সারিতে। আর আশ্চর্য, প্রতিদিন পথে বের হয়ে টুম্পা ভুলেই যায় তার বিগত ক্লান্তির কথা!
খোঁজাখুঁজি ছাড়াও রিকশাতে চেপে অথবা হেঁটে হেঁটে অথবা বেবিট্যাক্সিতে বসে কোথাও যাওয়ার সময় চঞ্চল হয় পড়ে টুম্পার চোখ। মেয়েটা তাকিয়ে থাকে বাসাবাড়ির গ্রিল বেয়ে নেমে আসা অথবা সদর দরজা থেকে ঝুলে পড়া বিভিন্ন মানিপ্ল্যান্টের দিকে এবং তাদের মৃত মানিপ্ল্যান্টের চেহারার সাথে সেসব মানিপ্ল্যান্টের চেহারা মিলিয়ে দেখতে সে সচেষ্ট হয়। জিগাতলার বাসাটার বারান্দায় টবে বসানো বিভিন্ন গাছের সাথে অবসরে বসে থাকে বিষণ্ন টুম্পা আর মাঝে মাঝেই সে আনমনে তাকিয়ে থাকে গ্রিলটার দিকে যেখানে একদা পল্লবিত হয়েছিল অপরূপ মানিপ্ল্যান্ট। হয়ত মেয়েটার দীর্ঘশ্বাসও পড়ে একটু! ক্রমশ মুছে যেতে থাকে মেয়েটার ঠোঁটের উজ্জ্বল হাসি, তার সুন্দর মুখের কৌতুকময়তা নিভে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। দিনশেষে অফিস থেকে ফিরে শিহাব তাকায় টুম্পার বিষণœ চোখে, ঘনিষ্ঠভাবে হাত ধরে মেয়েটার, অনেক আদরে মেয়েটার চুলে আঙুল বুলায়, কপালে এঁকে দেয় ছোটো চুমু। তখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে টুম্পার নিভে যেতে থাকা চোখ। টুম্পা গান গায় গুনগুন করে, স্কুলের মজার মজার গল্প বলে টুকটাক এবং এলেবেলে কথাবার্তার পরে গভীর ঘুমে সে ডুবে যায় শিহাবের বুকের ভেতর। কিন্তু টুম্পার বিষন্নতা কাটে না কিছুতেই। আর তাই ক্রমাগত অস্থিরতার ঘোরের ভেতর ঢুকে যেতে থাকে শিহাব এবং তার আর নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম হয় না দিনের পর দিন।
এমন এক ছুটির দিনে, শনিবারে, ভাদ্রের তপ্তদুপুরে তাদের মৃত মানিপ্ল্যান্টের সমিল কোনো মানিপ্ল্যান্টের খোঁজে আবার বের হয় তারা দু’জন। টুম্পার জনৈক বন্ধুর পরামর্শে বকশিবাজারে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছের একটা নার্সারিতে তারা যায়। সেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসার পরে তাদের ভীষণ ক্লান্তি লাগে। বিছানায় শুয়ে নিশ্চুপ টুম্পা তার মুখ ফিরিয়ে রাখে পুবের দেয়ালের দিকে। চিৎ হয়ে শুয়ে ঘূর্ণয়মান সিলিং ফ্যানের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিহাব ভাবে, এভাবে টুম্পার পাগলামিতে পরে দিনের পর দিন মানিপ্ল্যান্ট খুঁজে বেড়ানো তো অসম্ভব! তাই তখন ফের টুম্পার ওপরে বিরক্তি ঝেরে বসে শিহাব: বহুত হইছে! এইবার মানিপ্ল্যান্ট খুঁজাখুঁজি থামাইবা তুমি! এরপর কিন্তু তোমারে সাইক্রায়াটিস্টের কাছে যাইতে হইব!
সাথে সাথেই যেন কোনো বারুদের পিপায় আগুন ধরে যায় অপ্রত্যাশিতভাবে। একলাফে বিছানাতে উঠে বসে  চিৎকার দেয় টুম্পা: জ্বলজ্যান্ত একটা মানিপ্ল্যান্ট মইরা গেল আর তা নিয়া তুমি আমার সাথে কতই না চ্যাতাচেতি করলা! কিন্তু তোমার ভেতরে এখন কোনো কষ্টটষ্ট কিছুই নাই! আশ্চর্য! এই বলে টুম্পা তার নতুন কেনা স্মার্ট ফোন দেয়ালে ছুঁড়ে মেরে ভেঙে ফেলে।
টুম্পার অস্বাভাবিক রাগের বহর দেখে তখন খুবই বিচলিত আর খুবই অস্থির হয়ে পড়ে শিহাব। সেও বিছানাতে উঠে বসে চকিতে টুম্পার দু’বাহু ধরে কয়েকটা শক্ত ঝাঁকুনি দেয় এবং এলোমেলোভাবে বলতে থাকে: কেন এত পাগলামি করতেছ তুমি? তোমার এই দুঃখি দুঃখি চেহারা আর কতদিন দেখতে হইব আমারে? নতুন একটা মানিপ্ল্যান্ট কিন্না আনতে কী অসুবিধা হইতেছে তোমার? অনেক দিনে, অনেক রাতে জমানো শিহাবের এসব প্রশ্নমালা আজ খুব সহজেই অগ্নুৎপাতের পথে ধায়।
তখন টুম্পা শিহাবের চোখে তাকায় এবং সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। হতভম্ভ হয়ে টুম্পার দিকে তাকিয়ে থাকে শিহাব। সে কী বলবে তা বুঝতে পারে না। সে কেবল টুম্পাকে বলতে শোনে: প্রিয় মানিপ্ল্যান্ট মরে যায়, প্রিয় মানুষও মরে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়! হয় না কি? তবে কি তাদের প্রেমও একদিন এভাবে ধীরে মুছে যাবে?  
আবেগে টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে শিহাব এবং সে বলে: এটা কেবল একটা সম্ভাবনা মাত্র! সম্ভাবনা নিয়ে তবে আমাদের এত শঙ্কিত হওয়া কেন, মন খারাপ করাই বা কেন? মানিপ্ল্যান্ট তো আর এমনি এমনি বেঁচে থাকে না। তার জন্য মাটি লাগে, আলো লাগে, হাওয়া লাগে, পানি লাগে। তারপর ছোট্ট চাড়ায় কুসি জাগে অনেক, কুসি থেকে জাগে হালকা সবুজ পাতা, পাতার সবুজ রঙ ক্রমশ গাঢ় হয়, সবুজ পাতায় জাগে হলুদ হলুদ ছোপ, আবার নতুন নতুন কুসি গজায়, মানিপ্ল্যান্ট লতায় দুর্বার গতিতে, লতার পরে লতা দীর্ঘ হয়, মানিপ্ল্যান্ট ক্রমশ উপচে পড়ে গ্রিল থেকে নিচে, আরো নিচে।  
অশ্রুসজল চোখে টুম্পা শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলে: সত্যি তো?
টুম্পার রেশমসম চুলে আঙুল বুলাতে বুলাতে শিহাব উত্তর করে: সত্যি।
শিহাবের কথায় তখন টুম্পার কান্না থামে এবং সে অভ্যাসমতো পুবপাশের দেয়ালের দিকে কাত ফিরে শোয় আবার। শিহাবের মনে হয় যে টুম্পাকে সে সঠিক কথা বলেনি। অনিশ্চয়তাই তো আসলে এই পৃথিবীর মূল নিয়ম! ভুল কিছু তো বলেনি টুম্পা! আর এমনো তো হতে পারে, শিহাবের যুক্তিতে মেয়েটা নির্ভরতা পায়নি মোটেই, কেবল এই মুহূর্তের জন্যই কান্নাটুকু থেমেছে তার। তবু টুম্পাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে শিহাব টুম্পাকে বলে: তা হইলে চল, কালকেই একটা নতুন মানিপ্ল্যান্ট কিন্না নিয়া আসি।
টুম্পা সংক্ষেপে উত্তর দেয়: আচ্ছা।
পরদিন বিকালে শিহাবকে সাথে নিয়ে টুম্পা যায় ইস্কাটনের সব্জিবাগান রোডে। ভাদ্র্রমাসের তীব্র রোদে এনার্সারি থেকে ওনার্সারিতে ঘুরতে থাকে টুম্পা। তার থুতনিতে জমতে থাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সূর্যের আলোতে চিকচিক করে মেয়েটার রেশমসম বাদামি চুল। তার কন্ঠাস্থির সম্মিলনের ছোট্ট একটা কাল তিল জ্বলজ্বল করে হীরকখণ্ডের মতো। তার গভীর চোখ বাঙ্ময় হয় অনেক উচ্ছ্লতায়, অনেক হাসিতে।
সেখানের একটা নার্সারি থেকে নতুন একটা ছোট্ট মানিপ্ল্যান্ট কিনে ফেলে টুম্পা। শিহাব তার প্রিয়তম পাতাকে বলে: এই মানিপ্ল্যান্টটাও যদি মইরা যায় তা হইলে আমরা আরেকটা মানিপ্ল্যান্ট কিনব। হ্যাঁ?
টুম্পা হাসে। তার চোখে স্পষ্ট হয় অনুমোদন। সে উত্তর দেয়: আচ্ছা।
তারপর জিগাতলা পোস্ট অফিসের ঠিক সামনের বাসাটার দোতলার গ্রিলে শোভা পায় নবীন পাতার সেই ছোট্ট মানিপ্ল্যান্ট। নতুন মানিপ্ল্যান্টটার পাতা খুবই উজ্জ্বল, গাঢ় সবুজ, সবুজের ভেতরে গাঢ় হলুদ ছোপ। কোনো অংশেই মৃত মানিপ্ল্যান্টটার চাইতে কম সুন্দর নয় নতুন মানিপ্ল্যান্টটা।   
 লেকসার্কাস, কলাবাগান, ঢাকা/ ২০১৪