চারুকলায় ভর্তি হওয়ার আগে থেকে কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয়। তবে ১৯৬৩ সালে আমি যখন চারুকলায় ভর্তি হই, তাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। মাঝখানে তিনি কিন্তু শিক্ষকতা ছেড়ে পত্রিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। পরে আবারো ফিরেছেন শিক্ষকতায়।
কাইয়ুম চৌধুরী খুব সহজ সরল একজন শিল্পীর নাম। কেবল পেইন্টিং নয়; প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন, গ্রাফিক ডিজাইন সব মাধ্যমে সহজাত দক্ষতায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। শিল্পী হিসেবে অনেক বড় মাপের একজন মানুষ তিনি। তার কাজের রয়েছে নিজস্ব একটি ধরন, স্টাইল। রঙ নিয়ে খেলা করেছেন নিজের মতো করে। প্রাইমারি কালার বা প্রাথমিক রঙ আমরা যাকে বলি, তুলি হাতে এসব রঙের চমৎকার ব্যবহার করেছেন অবলীলায়, অসাধারণভাবে।
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী শুরুর দিকে যখন লোকজ থিম নিয়ে কাজ করতেন, তখন এত এত রঙের ব্যবহার দেখা যায়নি। পরে তিনি ক্যানভাসে লাল, সবুজ, হলুদ, নীলসহ উজ্জ্বল রঙের প্রাধান্য নিয়ে এসেছেন। একসঙ্গে প্রাইমারি এ রঙগুলো নিয়ে কাজ করাটা কিন্তু যে কোনো শিল্পীর জন্যই বেশ কঠিন। তবে রঙগুলো নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, এখানেই তিনি অনন্য আর নতুন একটি মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছেন। এমনভাবে প্রাইমারি রঙ নিয়ে খেলা করেছেন শিল্পী কামরুল হাসান। তবে তাদের দুজনের কাজে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। শিল্পবোদ্ধা যে কেউ ক্যানভাসে চোখ রেখে বলে দিতে পারেন এটা কামরুল হাসান বিংবা কাইয়ুম চৌধুরীর তুলির আঁচড়।
পাশাপাশি ফোক আর লোকজ বিভিন্ন উপাদান আর গল্পকে ক্যানভাসে কাইয়ুম চৌধুরী তুলে ধরেছেন অনবদ্যভাবেই। তৈরি করলেন নিজস্ব একটা স্টাইলও। তার আঁকা লোকজ স্টাইলকে দিয়ে তিনি কিন্তু চিত্রকলার নতুন একটি ধারা তৈরি করেছেন। প্রথম দিকে তিনি যখন লোকজ মোটিফগুলো নিয়ে কাজ করেছেন, তখন এত রঙের প্রাধান্য ছিল না। পরবর্তী সময়ে অনেক রঙের সমাবেশ ঘটিয়েছেন ক্যানভাসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঙের পাশাপাশি ছবির আঙ্গিকেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম দিকে যেভাবে শুরু করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তার ছবিগুলো অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল। খুব সাবলীলভাবে স্টাইল পরিবর্তন করে গেছেন।
পেইন্টিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে একই ধারা বজায় রেখে বুক কাভারের ডিজাইন করেছেন। কাইয়ুম চৌধুরীর বুক কাভারগুলো দেখলে সহজে বুঝতে পারবেন, এটা তার করা। এ কাজের জন্যই কৃতিত্বের দাবিদার তিনি। কারণ বুক কাভার করার জন্য লেখক ও পাঠক এ দুটো বিষয় মাথায় রাখতে হয়।
কাইয়ুম চৌধুরী একসময় চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকেছেন, ফিল্মের সেট করেছেন। তার গানের প্রচুর সংগ্রহ রয়েছে। পুরনো বাংলা গানের পাশাপাশি ক্লাসিক্যাল মিউজিকের বড় ধরনের সংগ্রহ ছিল। শিল্পকর্ম আর বইও সংগ্রহ করেছেন। পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন, খোঁজ রাখতেন বাজারে নতুন কোনো বই এসেছে কিনা। কেবল যে বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, ইলাস্ট্রেটিং করেছেন তা নয়, বই পড়তেন তিনি।
যেহেতু তিনি পড়তেন, তাই তার লেখার হাতও ভালো ছিল। কবিতা, ছড়া এমনকি অন্য লেখার ক্ষেত্রেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তার লেখা দেখে মনে হতো না এটা কোনো শৌখিন লেখা। আমি নিজে তার ছড়ার ভীষণ ভক্ত।
(শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ৯ মার্চ ১৯৩৪, গত ৩০ নভেম্বর ২০১৪ তিনি আকস্মিকভাবে প্রয়াত হন)