কথার ফাঁকে ফাঁকে সুফী তাকাচ্ছিল সংঘমিত্রার দিকে যতটা সম্ভব অভদ্রতা এড়িয়ে। এই প্রথম সে একটা মেয়ের এতো কাছে বসে এতক্ষণ ধরে কথা শুনছে। এ রকম অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। ও ঠিক করতে পারছে না মেয়েটি সুন্দর কীনা? ওর চোখ দুটো স্বভাবতই একটু বাঁকা, সমতল ভূমির মেয়েদের মতো না। অতো বিস্ফারিতও না। ওপরের চোখের পাতায় ভাঁজটা প্রায় দেখা যায় না। হাসলে চোখের মণিটা প্রায় লুকিয়ে যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে চোখ দুটো এতো সুন্দর কেন? এ রকম জন্ম-কাজল পরানো চোখ সে কি আগে কোনদিন দেখেছে? নিজের দেশের মেয়েদের চোখ এ রকম নয় এবং হয়তো সৌন্দর্যের মাপকাঠির বিচারে সংঘমিত্রা বেশি নম্বর পাবে না। নাকটাও চাপা। ওদেশের সকলেই তো এ রকম। কিন্তু মুখের গড়নটা সবশুদ্ধ বেশ মনকাড়া। আর ও যখন বাখনখানি দিয়ে মোমো খাচ্ছিল তখনই লক্ষ্য করেছে ওর লম্বা ফর্সা আঙুলগুলো। কিন্তু সব মিলিয়ে সৌন্দর্যের মাপকাঠির বিচারে সুফীর কেন এ রকম পক্ষপাতিত্ব করতে ইচ্ছে করছে? মনে মনে ওকে অনেক নম্বর দিয়ে খুশি লাগলো।
মেয়েটি মনে হয় বেশিই কথা বলে। আর সুফী ঠিক উল্টো। বেশ চুপচাপ, বিশেষ করে নতুন লোকের সামনে। মাঝে মাঝে খুঁজেই পায় না কী কথা বলবে। এ রকম একটা নতুন পরিচিত মেয়ের সামনে তার মুখ একদম বন্ধ।
সংঘমিত্রা বলতে লাগলো, ‘বাবা আমাকে প্রথমে বোর্ডিং স্কুলে পাঠালেন দার্জিলিং-এ। আমার তখন সাত বছর বয়স। আমার রুমমেট ছিল কোলকাতার এক বাঙালি মেয়ে। ওকে আমি টেবিল টেনিসে হারিয়ে দিতাম বলেই বোধহয় আমার সাথে খুব বনতো না তার। তবে সেই থেকে আমি বাংলা বলতে শিখলাম। পরে একটু বড় হয়ে এলাম শান্তিনিকেতনে। বাবার খুব ভাল ধারণা ছিল এখানকার পড়াশোনার ধরনে। বাবা বলতেন, রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন বটে তবুও ওখানে যাঁরা পড়ান তাঁরা এখনও কবির মুক্তচিন্তা আর তারই ভেতরে আনন্দ খোঁজার ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন। তখন অবশ্য আমার বেশি ঝোঁক ছিল ব্যাডমিন্টন খেলায়। পড়াশোনায় অতো মন ছিল না। আপনি এসব খেলেন, না সবসময় ভাল ছেলেদের মতো পড়ার বইতে নাক ডুবিয়ে থাকেন?’
সংঘমিত্রা একটু হাসলো। ভালো করেই হাসলো। কুঁচকে গেল তার পাতলা ঠোঁট দুটো। একটু ফাঁক হলো। আর দাঁতগুলো এতো সাদা আর সুন্দর! টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে তাকে সুন্দর মানাতো বলে মনে হলো সুফীর। কোন মেয়ে আগে ওর সাথে এতো সহজ অথচ আন্তরিকভাবে কখনো আলাপ করেনি।
একটু পরে মেয়েটি উঠে গেল টয়লেটে। সুফী লক্ষ্য করলো ওর সুঠাম শরীর। নিশ্চয় বেশি খেলাধুলা করে বলেই এ রকম ঋজু আর সহজ সোজা সাপ্টা ভঙ্গি। মেয়েটির মনটাও নিশ্চয়ই খুব সরল হবে। লাল রঙের সালোয়ার পাজামা পরেছে। তার সাথে সবুজ ওড়না। সব মিলিয়ে সুফীর মনেও একটা সহজ ভাব আসতে লাগলো। একটা অজানা অচেনা মেয়ের সাথে কথা বলতে যে সংকোচ প্রথমে আসে, সেটা আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।
সংঘমিত্রা বললো, ‘আপনি কিছু বলছেন না, আমিই খালি কথা বলছি নিজের সম্বন্ধে। এবার আপনি বলুন। আপনার জীবনটা কী বেশ বর্ণিল নয়? কতো জায়গায় গেছেন, কতো পড়াশোনা করেছেন, কতো কিছু দেখেছেন এই এত অল্পদিনের ভেতর আপনি?’
‘আমি শুধু সারা জীবনে ঢাকাতেই কাটিয়েছি। একবার খুব ছোটবেলায় কোলকাতায় গেছিলাম। তখন ভারতে যাওয়ার জন্য ভিসা লাগতো না। তাই বিদেশ বলে মনে হয় নি। আর কিছুই মনে নেই সেই শহরের। আমার জীবনে বিশেষ কোন বৈচিত্র্য নেই। আমি প্রথম কেমিস্ট্রি পড়লাম ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু শেষ না করেই তারপর ছেড়ে দিলাম। পরে জার্নালিজমে এম.এ করলাম। ছোটবেলা থেকেই লিখবার অভ্যাস ছিল বাংলায়। তাই পাশ করেই যোগ দিলাম খবরের কাগজে, জার্নালিস্ট হবো বলে। তা নইলে খাওয়া জুটবে না। বাংলাতেই লিখি বেশি দেশ-বিদেশের খবর। বন্যা, ঝড়, আগুন লাগা, সড়ক দুর্ঘটনা, পুলিশের অত্যাচার এইসব আর কি। সাক্ষাৎকারের জন্য রাজনৈতিক লোকদের কাছে ধর্না দিই। মাঝে মাঝে ইংরেজিতেও লিখতে হয়। সেই রকম দায়িত্ব নিয়েই যাচ্ছি বম্বে। দুটো খবরের কাগজের প্রতিনিধি হয়ে আপনাদের কংগ্রেসের অধিবেশনে।’
বলতে বলতে খড়গপুর স্টেশন এসে গেল। ড. গুপ্ত জানালার কাছে বসে ছিলেন। বললেন, ‘প্ল্যাটফরমে মিহিদানা বিক্রি হচ্ছে। যদিও বর্ধমানই হচ্ছে ও জিনিসের জন্য বিখ্যাত। তবুও খড়গপুরের দূরত্ব খুব বেশি নয় ওখান থেকে। গাড়ি থামলে আমি কিনে আনবো সবার জন্য।’
‘না না, আপনি কেন যাবেন কষ্ট করে, আমিই যাবো’ বললো সুফী।
সুফী কিনলো আধা কেজি মিহিদানা। কমলালেবুও বিক্রি হচ্ছিল। আধ ডজন লেবুও নিলো। দেরী হয়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ফিরে চললো নিজের কামরার দিকে। প্ল্যাটফরমটা কি লম্বা খড়গপুরের!
এসে দেখে কামরার দরজায় তালা দেয়া। খোলা যাচ্ছে না। আর কামরার ভেতরেও কেউ নেই, একদম খালি। অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। একজন গার্ড গোছের লোক যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। সুফীকে অসহায়ের মতো দেখে সে দরজার ওপর দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো।
দরজার ওপরে চক দিয়ে লেখা আছে ‘দিস ক্যারেজ ইজ সিক’।
এ রকম অভিজ্ঞতা সুফীর জীবনে প্রথম। ট্রেনের কামরা কী করে অসুস্থ হলো?
বোকার মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এমন সময় দেখলো কয়েক কামরা পর অন্য একটি কামরার জানালা দিয়ে হাত নাড়ছে সংঘমিত্রা, ‘এদিকে, এখানে আসেন’। সুফী দু’হাত ভর্তি খাবার নিয়ে দ্রুত হেঁটে চললো নতুন কামরার দিকে।
সংঘমিত্রা বলতে লাগলো, ‘এ রকম ব্যাপার জীবনে শুনিনি। আপনি চলে যাবার পরই এক রেলওয়ে গার্ড এসে আমাদের বললো, এই কামরা আলাদা করে রাখা হবে। কারণ এটা ‘সিক’। আপনাদের জন্য নতুন একটা কামরা লাগানো হয়েছে সামনে। সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যান সেখানে। তাই করলাম। আপনার মালপত্রও নিয়ে এসেছি। আর এরপর তো রাত হবে, শুতে হবে। তাই আপনার জন্য এখানে চাদর বিছিয়ে দিয়েছি, যাতে আর কেউ এখানে জায়গা দখল করতে না পারে।’
নতুন কামরাটা আগেরটার চাইতে সুন্দর, আর এর জায়গাও বেশি।
‘ভালই হলো। অনেক ধন্যবাদ’, বললো সুফী।
সংঘমিত্রা বলতে লাগলো, ‘আপনি যখন মিহিদানা কিনতে গেছিলেন তখন আরো দুটো ব্যাপার হয়েছে। এখানে রাত্রের খাবারের অর্ডার দেয়া যায়। আমরা ডাল-ভাত, মাছ আর সবজির অর্ডার করেছি তিনজনের জন্য। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। যদি অন্য কিছু খেতে চান তার ব্যবস্থা হয়তো করা যেতে পারে। তা নইলে আমরা যা বলেছি তাই চললে কোন প্রবলেম নেই। আমার তো মনে হয় এই মিহিদানা ডিনারের পর খেলেই হয়। আপনি তো আবার বুদ্ধি করে কমলালেবু নিয়ে এসেছেন। এখনকার মতো এই কমলালেবুগুলো খেলে আমার চলে যাবে। আপনাদের চলবে কি?’
‘আরেকটা কি ব্যাপার যেন আমার অবর্তমানে হলো?’ জিজ্ঞেস করলো সুফী।
‘হ্যাঁ, ওটা স্যার বুঝিয়ে বললে বোধহয় ভালো হবে।’
ড. গুপ্ত বললেন, ‘আমরা রাত্রের দিকে নাগপুর পৌঁছাবো। নাগপুরে যদি নেমে যাই তাহলে আমরা সেখান থেকে কাল দিনের বেলা অজন্তা আর ইলোরা দেখতে যেতে পারি। বেশি দূরে না। ট্যাক্সি নিতে হবে। শুনেছি রাস্তাঘাট নাকি ভালই ওখানে। শুধু এক রাত্রি আমাদের নাগপুরে কোন হোটেলে থাকতে হবে। আর যদি ধীরে সুস্থে সব দেখতে চাই তাহলে দু’রাত থাকলে আশেপাশের অনেক জায়গা যেমন আওরঙ্গাবাদ দুর্গও দেখা যেতে পারে। গার্ড বললো, ট্রেনের যে টিকেট আছে আমাদের এই টিকেটই চলবে। শুধু বাড়তি খরচ হোটেল আর যানবাহনের। কি বলেন, আপনি রাজী?’
একটু চিন্তা করে সুফী বললো, ‘ব্যাপারটা তো বেশ লোভনীয় ঠেকছে। অজন্তা ইলোরার ছবি দেখেছি। চাক্ষুস দেখতে পাবো কোনদিন ভাবিনি। তবে আমরা ঠিক সময়মতো বম্বে পৌঁছতে পারবো তো? আমি প্রথম দিনের উদ্বোধনী মিস করতে চাই না। আমার কাগজের জন্য কপি পাঠাতে হবে।’
ড. গুপ্ত বললেন, ‘হ্যাঁ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদেরও থাকতে হবে। অবশ্য সেটা হয়ে যাবে যদি ট্রেনের টাইম ঠিক থাকে। আগে এই ট্রেন লাইনের নাম ছিল বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে, সংক্ষেপে বি.এন.আর। দুষ্টু লোকে বলতো এর মানে বি নেভার রেগুলার। তখনকার দিনে প্রায় লেট থাকতো। এখন অবশ্য সবগুলো রেল একসঙ্গে করে ইন্টার্ন রেলওয়ে বলে। তাই মনে হয় নতুন নামের মান রাখতে পাংচুয়ালিটি বজায় রাখতে চেষ্টা করবে।’
সুফী ওদের দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তাহলে এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন? অজন্তা ইলোরা দেখার সুযোগ যখন এসেছে তখন আর ছাড়ছি না।’
ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। সন্ধ্যা হচ্ছে। ড. গুপ্ত বললেন, ‘জানো তো খড়গপুর জংশনের প্ল্যাটফরম প্রায় মাইলখানেক লম্বা। পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা প্ল্যাটফরম এটি। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে এর নাম আছে।’
পরের স্টেশনে খাবার-দাবার এলো। পরে মিহিদানার সদ্ব্যবহারও হলো।
ড. গুপ্ত ওপরের বাংকে উঠে গেলেন শোবার জন্য। একটু শীত শীত করছিল। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তায় কোলকাতায় শীতের মাত্রা বেশি ছিল না। কিন্তু মধ্যভারতের দিকে এসে রাতে বেশ শীত করতে লাগলো।
সংঘমিত্রা বললো, ‘আপনি গায়ে দেবার জন্য কিছু এনেছেন? চাদর বা ওরকম কিছু?’
সুফী বললো, ‘এই শীতে আমার সোয়েটারই যথেষ্ট হবে। বেশি শীত তো নয় এখানে।’
‘না, হবে না। এই নিন, আমি একটা চাদর দিচ্ছি আপনাকে। এটা গায়ে দেবেন।’
সংঘমিত্রা হাত বাড়িয়ে চাদরটা দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ বাইরে বিকট শব্দ। কারণ তখন ট্রেনটা একটা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কামরার আলো জ্বালানোর দরকার হয়নি। বাইরে তখনো আলো। সুড়ঙ্গে ঢুকতেই ট্রেনের কামরাটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল।
‘আই মাম্মী’ ভয়ের একটা মৃদু চিৎকার করে উঠলো সংঘমিত্রা। সুফীর হাতটা ধরে অজান্তেই নিজের দিকে একটু টানলো আর ওর কাঁধটা ধরে বেশ জোরে সুফীকে আঁকড়ে ধরে থাকলো। যতক্ষণ ট্রেনটা টানেল পার না হলো আর দিনের আলো ফিরে না আসা পর্যন্ত সংঘমিত্রা সুফীর হাতটা ছাড়লো না। তারপর একটু সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বললো, ‘কিছু মনে করবেন না। এ রকম হঠাৎ অন্ধকারকে আমার ভীষণ ভয় করে। তখন কী যে করি ঠিক থাকে না।’
সূর্য অস্ত যাচ্ছে তখন। একটু পরেই অন্ধকার হবে। সুফী উঠে গিয়ে কামরার আলোর সুইচ টিপে দিলো। সংঘমিত্রাকে বললো, ‘যাক এবার আর ভয় করবে না তো?’
সংঘমিত্রা ওর ছোট ব্যাগটা হাতড়ে আর একটা চাদর বের করলো। টকটকে লাল আর সুন্দর দেখতে। ‘এটা আমার দিদি দিয়েছে। আমি গায়ে দেব রাত্রে।’
ওরা দু’জন দুটো বেঞ্চে আরাম করে শুয়ে পড়লো। অন্য প্যাসেঞ্জাররাও শোবার বন্দোবস্ত করছে।
(৪)
একটা হিন্দুস্তানী পরিবার ওপাশে। বাবা-মায়ের সাথে একটা বছর দশেকের মেয়ে।
মেয়েটির মাকে সংঘমিত্রা জিজ্ঞেস করলো, ‘রাত্রে রাধা গায়ে দেবে কি? বেশ ঠাণ্ডা পড়তে পারে কিন্তু।’
মা ওকে বললো হিন্দিতে, ‘আপ শোঁচিয়ে মাত। উও মেরে পাশ শোয়ে গি। ঠান্ডা নাহি লাগে গা। ধানইয়াবাদ।’
সুফী বুঝলো সংঘমিত্রা এর মধ্যেই ওদের সাথে আলাপ করে নিয়েছে। তার কেনা একটা কমলালেবুও রাধার হাতে।
সুফী বললো, ‘আপনি ঘুমিয়ে পড়লে আমি আলো নিবিয়ে দেব। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
‘না, এমন অন্ধকারে আমি ভয় পাই না। তবে হঠাৎ যদি কখনো অন্ধকার হয়ে যায় তখন মাঝে মাঝে ভয় লাগে। এটা আমার ছোটবেলার একটা বদভ্যাস বা ফোবিয়া আর কি। এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’
সুফীর ঘুমিয়ে পড়তে দেরী হলো না। কে যে কামরার আলো নিভিয়ে দিলো ওর মনে থাকার কথা নয়।
রাতে ড. গুপ্ত জাগিয়ে দিলেন, ‘ওঠো নাগপুর এসে যাচ্ছে। আমাদের নামতে হবে।’
সব গুছিয়ে নিতে নিতে স্টেশন এসে পড়লো। ওরা নামছে। অন্যরা সব ঘুমুচ্ছে তখন। হঠাৎ সুফী তাকালো সংঘমিত্রার দিকে। ওর সালোয়ার কামিজ ঠিক করছিল তখন। দেখলো ওর লাল ওড়নাটা পাশের বেঞ্চের ছোট মেয়ের গায়ে বিছানো।
‘ওটা আপনার না?’
‘হ্যাঁ, রাধার গায়ে চাদর ছিল না দেখে আমারটা ওর গায়ে দিয়েছিলাম।’
‘বাইরে তো বেশ ঠাণ্ডা। আপনি বরং আমাকে যেটা দিয়েছিলেন সেটা নিন। রাধার চাদরটা কী নিতে পারবেন? ওতো ঘুমুচ্ছে এখনও।’
‘আমার সোয়েটার আছে, চলে যাবে। আপনাকে যেটা দিয়েছি সেটা ফেরত দিয়ে বেশি বেশি সিভালরি দেখাতে হবে না।’ ধমকের সুরে বললো সংঘমিত্রা।
স্টেশনের কাছের হোটেলে দুটো রুম পাওয়া গেল। একটা ডবল রুমে ড. গুপ্ত আর সুফী থাকবে। আর অন্য ঘরে সংঘমিত্রা। চার পাঁচ ঘণ্টা একটু ঘুমুতে বা বিশ্রাম নিতে পারবে।
হোটেল থেকেই ট্যাক্সি ঠিক করে দিল সারাদিন ওদের সাথে থাকবে।
অজন্তা, ইলোরা আর আওরাঙ্গাবাদ দেখিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফেরত আসবে। তারপর রাতটা হোটেলে কাটিয়ে সকালে আবার বম্বের ট্রেন ধরতে হবে।
হোটেলের খাটে শুয়েই সুফীর চোখে ঘুম এসে যাচ্ছিল। আলো নিবিয়ে দু’জনেই শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ড. গুপ্তের চোখে ঘুম নেই। তিনি সুফীর সাথে কথা বলতে থাকলেন অন্ধকারের মধ্যেই নিজের খাটে শুয়ে।
‘আমরা ঢাকায় থাকতাম টিকাটুলিতে। সেগুনবাগিচার কথা মনে আছে। সেখানে যেতাম আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল একটা খুব বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। এপ্রিল-মে মাসে সে গাছে ফুল হতো এমন যেন সেখানে আগুন লেগেছে। সে গাছটা কি এখনো আছে? আমরা সিনেমা দেখতে যেতাম সদরঘাটে লায়ন সিনেমা হলে। সেটাও কি আছে? আর একটা নতুন হল হচ্ছিল তখন বাড়ির কাছেই। নাম ‘অভিসার’। কিন্তু ওখানে কখনো যাই নি। আপনি আজ বাখরখানি খাওয়ালেন। সেটা খেয়েই পুরনো দিনের স্মৃতি ভিড় করে এলো।’
সুফী হুঁ হুঁ করে গেল। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল ড. গুপ্তের ছাত্রী সংঘমিত্রা সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে। কিন্তু সুফী কিছু জিজ্ঞেস করার আগে বলতে লাগলেন তিনি, ‘আবার ঢাকায় যেতে ইচ্ছে করে। আবার করেও না। শুনেছি অনেক কিছু বদলে গেছে। আগের দেখা শহরকে কী চিনতে পারবো? বেশি বদলে গেলে চিনতে না পারলে আবার হয়তো খারাপ লাগবে।’
সুফী লক্ষ্য করলো ড. গুপ্তর কণ্ঠস্বর যেন বেশ উঁচু গ্রামে বাঁধা। ট্রেনে যখন তিনি কথা বলছিলেন তখনই সে খেয়াল করেছিল তিনি বেশ জোরে কথা বলেন। তখন সুফী ভেবেছিল যে, ট্রেনের চলার আওয়াজের জন্য তিনি বোধহয় অতো জোরে জোরে কথা বলছিলেন। কিন্তু এখন দেখলো এই নিঝুম রাতেও তিনি প্রায় চেঁচিয়ে কথা বলছেন। তারা দু’জন একটা ছোট ঘরে পাশাপাশি দুটো খাটে শুয়ে আছেন। সেখানে এতো জোরে কথা বলার কোন দরকার নেই। বুঝলো, এটা নিশ্চয়ই তাঁর বহুদিনের অভ্যাস। প্রথম প্রথম এ রকম উঁচু গলার কথা শুনতে একটু অস্বস্তি লাগে বৈকি।
তিনি একটু চুপ করে আবার বলতে লাগলেন, ‘আমি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট বের হতে কয়েক মাস দেরি। পড়াশোনার চাপ নেই। হাতে কোন কাজ নেই। সেগুনবাগিচায় মাঝে মাঝে বুদ্ধদেবের ওখানে আড্ডা দিতে যেতাম। হঠাৎ একদিন শুনলাম, পাশের খালি বাড়িতে একজন নতুন ভাড়াটে এসেছেন। তিনি মুসলিম লীগের পলিটিক্স করেন। ওই বাড়ির এক ছোট মেয়ে লাল ফ্রক পরে বেনী দুলিয়ে স্কুলে যেত। কি জানি কেন মজা লাগতো দেখে। রোজ মেয়েটাকে আয়ার হাত ধরে স্কুলে যাবার দৃশ্যটা দেখার জন্য সকাল থেকে জানালার পাশে বসে থাকতাম। ওর নাম নিয়ে একটু অসুবিধায় পড়েছিলাম। আয়াটা ডাকতো ‘ও টুকু চলে এসো আর দেরি না’। আবার কখনো ডাকতো ‘টুকরা, দুষ্টুমি করো না কিন্তু!’ আমি ভাবতাম ‘টুকরা’ এ কেমন নাম? পরে শুনেছিলাম ওর নানীর বাড়ি পশ্চিম দেশে। তিনি নাতনির নাম দিয়েছিলেন ‘জিগারকা টুকরা’। আয়া অতো বড় নাম ধরে ডাকতে পারতো না। তাই বলতো শুধু ‘টুকরা’ এবং পরে ‘টুকু’। ওর মা ডাকতো ‘বুড়ি’ নামে।
টুকরাদের বাড়ির সামনের জায়গাটা বাঁধানো ছিল। একদিন দেখলাম মেয়েটা পায়ের জুতোর সাথে চাকা লাগিয়ে কি সুন্দর গড়গড়িয়ে ঘুরছে। আমি ওদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছিলাম। কোনদিন দেখিনি এ রকম জিনিস। টুকরা আমাকে দেখে হঠাৎ বললো, “তুমি রোলার স্কেটস ট্রাই করে দেখতে চাও?” ওই প্রথম আমি দেখলাম রোলার স্কেটস। “জুতো পরে আসতে হবে কিন্তু। স্যান্ডেল পরলে চলবে না।” জুতো পরে এলাম। স্কেটস দুটো আমার জুতোর তলায় লাগিয়ে আমি চেষ্টা করলাম ওর মতো তরতরিয়ে হাঁটতে। কিন্তু ব্যালেন্স হারিয়ে দড়াম করে পড়লাম। টুকরার কী হাসি! পরে আর কোনদিন চেষ্টা করিনি। ... কতো বড় হয়েছে এখন মেয়েটা দেখতে ইচ্ছে করে।’
সুফী কথার খেই ফিরিয়ে বললো, ‘হোটেলের লেপটা খুব পরিষ্কার ঠেকছে না। কতো লোকেরা যে এটা গায়ে দিয়েছে সারা বছর। ওরা ভালো করে ধুয়েছে কিনা কে জানে! আমি বরং সংঘমিত্রার দেয়া এই চাদরটা গায়ে দিয়ে শোব। কয়েক ঘণ্টারই তো ব্যাপার।’
‘হ্যাঁ, তাই করো। মেয়েটার মন খুব নরম আমি জানি। নিজের সুন্দর চাদরটা কেমন এক অজানা অচেনা মেয়েকে অনায়াসে দিয়ে দিল।’
তারপর একটু চুপ করে আবার বলতে লাগলেন, ‘আমিই ওকে নিয়ে এসেছিলাম শান্তিনিকেতন থেকে। ও বিশ্ব ভারতী থেকে আইএসসি দিয়েছিল। খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল পরীক্ষায়। আমি মাঝে মাঝে শান্তিনিকেমন যেতাম তখন। আগেই তো বলেছি আমার শিক্ষক ছিলেন সত্যেন বোস। সাতচল্লিশের পর আমরা কোলকাতা চলে এলাম। কোলকাতা ইউনিভার্সিটিতে তিনি জয়েন করলেন। আমাকেও নিলেন নিজের সাথে। আর তিনি ছিলেন মেঘনাদ সাহার সহপাঠী। একসাথে দু’জনেই কিছুদিন কাজ করলেন কিন্তু কেন জানি দু’জনে কিছুদিন পর ফিজিক্স ছেড়ে অন্যদিকে বেশি মনোযোগ দিতে লাগলেন। মেঘনাদ ভাবলেন দেশের জন্য কিছু করবেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন দেশে বিজ্ঞানমুখী করতে হবে। তা নইলে দেশের সত্যিকার উন্নতি করা সম্ভব হবে না। তার জন্য দেশের সরকারকে এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনীতি হচ্ছে সরকারের কাছে যাওয়ার একমাত্র পথ। রাজনীতির বাইরে থেকে সরকারকে এসব ব্যাপারে বোঝানো বড়ই দুরূহ কাজ হবে। মেঘনাদ সাহা তাই হলেন বহুর্মুখী। আর সত্যেন বোস হলেন অন্তর্মুখী। তিনি ছিলেন থিওরিটিক্যাল ফিজিসিস্ট। আর চিরজীবন ফিজিক্সের পরই তাঁর জীবনে ছিল সঙ্গীতের স্থান। তিনি অনেক সময় ব্যয় করতে লাগলেন গানের জগতে। ছুটিছাটা পেলেই তিনি ছুটতেন শান্তিনিকেতনে। সমমনা বহু লোকের সান্নিধ্যে তাঁর সময়টা ভালই কাটতো। পরে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। আমি যখনকার কথা বলছি তখনো তিনি কোলকাতায়। বিশ্বভারতীতে গেছি একবার ওঁদের সমাবর্তন উৎসবে। সংঘমিত্রার ফিজিক্সের প্রফেসর আমাকে বললেন মেয়েটার কথা। অংকে মাথা খুব ভালো। পার্টিকল ফিজিক্স পড়তে চায় ভবিষ্যতে। বুঝলেন কীনা, ক’বছর আগে হিরোশিমা নাগাসাকিতে আনবিক বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। এসব তরুণ ছাত্ররা তখন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে নানা রকম রোমান্টিক চিন্তা করছে। আইনস্টাইন, ওপেনহাইমার, সিভি রমন আর কৃষ্ণান তাঁরা ওদের হিরো। মেয়েটা পরীক্ষায় ভালো করেছে। ফিজিক্স আর অংকে তো বিশেষ করে ভালো। ওর শিক্ষক মেয়েটাকে রিকমেন্ড করছে। সত্যেন বোস যদি একটু বলে দেন তার বন্ধু মেঘনাদকে তাহলে ওকে আমাদের ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। তবে ও তো ভারতীয় নয়, নেপালের মেয়ে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে একটা বিদেশী মেয়েকে সুযোগ দেয়া যায় কীভাবে? মেঘনাদ সাহাকে বলতে তিনি সেটার ব্যবস্থা করলেন। বিশেষ করে তার আগ্রহ দেখে। বিধান রায় তখন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে বলা হলো কিন্তু তিনি জানালেন নাগরিকত্ব প্রদেশের ব্যাপার নয়। ওটা দিল্লীর দায়িত্ব। বিধান রায়ের অবাধ যাতায়াত ছিল নেহেরুর কাছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি রাজী হন, তাহলে আর বাধা কী?’
সুফী বললো, ‘একটা আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্রীকে ভর্তি করার জন্য আপনারা এত কাঠখড় পোড়ালেন?’
‘আসলে কী জানো, মেয়েটাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছিল। বিশেষ করে মেঘনাদ সাহার। আর মেয়েটাও জেদ ধরে বসেছিল যে, সায়েন্স কলেজে ভর্তি হতে না পারলে সে আর কোথাও পড়তে যাবে না। সে ভর্তি হলো শেষ পর্যন্ত। আর তারপর আমাদের সে মোটেও ডিসএপয়েন্ট করেনি।
মেঘনাদ সাহার প্রিয় ছাত্রী সে। তিনি তাকে তাঁর সাইক্লোট্রন প্রজেক্টে নিয়ে নিলেন। ভারতে প্রথম সাইক্লোট্রন তৈরি হয়েছিল মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে এই কোলকাতার সায়েন্স কলেজে। বার্কলীতে লরেন্সের তৈরি করা সাইক্লোট্রনের চাইতে অনেক ছোট এই সাইক্লোট্রন। কিন্তু সেটাও আর কেউ তখনো করতে পারেনি এদেশে।’
‘আপনিও ছিলেন নাকি এই প্রজেক্টে? যদিও এ ব্যাপারে আমি বিশেষ কিছু বুঝি না। কিন্তু জানতে চাই সাংবাদিক হিসেবে। বোধহয় কিছু জানা থাকলে কাজে লাগতে পারে।’
‘আমরা যে সায়েন্স কংগ্রেসে যাচ্ছি সেখানে এই বিষয় নিয়েই একটা পেপার পড়বো। আমার সাথে এই পেপারের কো-অথার হচ্ছে সংঘমিত্রা নোরবু। আমাদের দেশে এতো অল্প বয়সে খুব কমই বৈজ্ঞানিক আছে যে সাইক্লোট্রন সম্বন্ধে এতোটা জানে। একেবারে হাতেনাতে শিখেছে ব্যাপারটা। বহু কষ্ট আর অধ্যবসয়ের ফল এটা। আর ওর ডক্টরেটের থিসিস এটার ওপরেই। এ বছরই ওর ডক্টরেট হয়ে যেতে পারে। অবশ্য ওকে আরো একটু কষ্ট করে থিসিসের বইটা লিখতে হবে তার আগে।’
অঙ্কন: তাইয়ারা ফারহানা তারেক
(চলবে)