করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





হোমারের জন্য প্রশস্তিগাথা
মাসরুর আরেফিন
এ-বইটির শেষ প্রচ্ছদে গ্যেয়টের এক বিখ্যাত উক্তি আছে যে হোমার তাকে ‘সবসময় ঠেলে দেয় আশ্চর্য বিস্ময়ের জগতে।’ সেই কথাটা আর একটু বিশদ করে বলার লোভ সামলাতে পারছি না। গ্যেয়টে একদম কিশোর বয়সেই পড়ে ফেলেন তিনটি বই: আরব্য রজনীর কাহিনী, ইলিয়াড ও অডিসি।১৭ গ্যেয়টের বিখ্যাত উপন্যাস The Sorrows of Young Werther (‘তরুণ ভারথারের দুঃখবিষাদ’, ১৭৭৪), যা অনেকাংশেই তার আত্মজীবনীমূলক এক আখ্যান—সেখানে ভারথার তার গোপন চিঠিগুলোর প্রাপককে লেখে যে সে আর নতুন কোনো বই চায় না, কোনো দিকনির্দেশনাও চায় না জীবনে, কোনো উৎসাহও চায় না কারও থেকে; সে শুধু চায় ‘আমাকে দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়াবে এমন ঘুম-পাড়ানিয়া গান, যা আমার হোমারের মধ্যে প্রচুর পরিমাণেই আছে।’ এই গ্যেয়টেই ১৮২৭ সালে তার সাহিত্যকর্মের প্রামাণ্য সংস্করণের চতুর্থ খ-ে ঢুকিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন এক দীর্ঘ কবিতার খ-াংশ, নাম ‘Helena: A Classical Romantic Phantasmagoria’, নীচে সাবটাইটেলে লেখা ‘ফাউস্ট-এর জন্য সাংগীতিক মধ্যবর্তিকা’। আমরা জানি, ফাউস্ট গ্যেয়টের সেরা সাহিত্যকর্মের নাম। ফাউস্ট-এর গ্রেটখেন আর ইলিয়াড-এর হেলেনের মধ্যে কীভাবে গ্যেয়টে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন তা আমরা জানি না, কিন্তু গ্যেয়টের ভাষ্য অনুযায়ী এ দুই নারী চরিত্রই ‘ভুল শিক্ষা, মধ্যবিত্তের মানসিক সংকীর্ণতা, নৈতিক অবক্ষয় ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রমের শিকার’।১৮ বলা হয়ে থাকে, হেলেন শুরু হয় হোমারের হাতে, আর শেষ হয় গ্রেটখেন চরিত্রটির মধ্য দিয়ে গ্যেয়টের হাতে।১৯
১৮৩২ সালে গ্যেয়টে, মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগে, শেষ করলেন তার আত্মজীবনীর শেষ অধ্যায় লেখা। সেখানে তিনি উনবিংশ শতককে সৌভাগ্যময় এক শতক বললেন শুধু এ-কারণেই যে, এ শতকটিতে হোমারের পুনর্জন্ম হয়েছে। তিনি লিখলেন: ‘সাহিত্যিক সেই কালপর্র্বটি সুখী এক কালপর্ব হতে বাধ্য যখন অতীতের মহান সৃষ্টিগুলোর আবার পুনরুত্থান ঘটে, এবং সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ হয়ে ওঠে; কারণ কেবল তখনই ওসব সাহিত্যকর্ম নতুন এক অর্থ ও অভিঘাতের জন্ম দিতে পারে। আমাদের জন্য হোমারের সূর্য আবার জাগলো, এবং তা আমাদের সময়কার প্রয়োজনীয়তার শর্ত পূরণ করেই...আমরা তার ঐ কাব্যদুটোতে আর এখন হানাহানিতে ভরা, বীরদের বাড়াবাড়ির এক পৃথিবীকে দেখি না, বরং দেখি প্রয়োজনীয় এক বর্তমানের আয়নায় প্রতিফলিত সত্যকে। আমরা (এ শতকে) চেষ্টা করেছি হোমারকে যতটা সম্ভব আমাদের লোক করে নেওয়ার।’২০
ষোড়শ শতকের একদম শেষ ভাগে ক্রিস্টোফার মারলো গ্যেয়টের ফাউস্ট কাহিনীর আলোকে তার লেখা Tragical History of Dr Faustus-এ ইংরেজি ভাষায় প্রথম নাট্যরূপ দিলেন জাদুকর ডাক্তারের সঙ্গে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রূপসী নারীটির (হেলেন) সেই কিংবদন্তীসম সাক্ষাতের। সেখানে হেলেনের বর্ণনায় তিনি লিখলেন পরবর্তীকালে আরেক কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া তার পঙ্ক্তিগুলি:

Was this the face that launch’d a thousand ships,
And burnt the topless tower of Ilium?
Sweet Helen, make me immortal with a kiss

সেই থেকে হেলেনকে আমরা চিনি এক ভয়ংকর সুন্দরী হিসেবে, যার রূপের মোহে পড়ে রওনা দিয়েছিল হাজার জাহাজ। প্রসঙ্গত, ট্রয় অভিযানে গ্রিক রাজা আগামেমননের সঙ্গে এসেছিল মোট ১১৮৬টি জাহাজ, তারা ট্রয়ের পথে পাল তুলেছিল গ্রিসের আউলিস বন্দর থেকে ইলিয়াড-এর কাহিনীর সময়কালের দশ বছর আগে।
ক্রিস্টোফার মারলো-র আড়াইশ বছর পরে এডগার অ্যালান পো হেলেনের অবিনশ্বর সৌন্দর্যকে সমার্থক করলেন প্রাচীন পৃথিবীরই অপার সৌন্দর্যের সঙ্গে:

Helen, thy beauty is to me
Like those Nicaean barks of yore
That gently, o’er a perfumed sea,
The weary, wayworn wanderer bore
To his own native shore

এই যে সুগন্ধিভরা সাগরের ওপর দিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে যাওয়ার ক্লাসিক্যাল পৃথিবী, তার শুরুটাই হোমারের হাত দিয়ে। গ্রিসে, হোমারের মৃত্যুর আনুমানিক তিন শ বছর পরে, সক্রেটিসের জীবনকালে, ইলিয়াড আবৃত্তির সময়ে চারণকবিদের হাতে আর সেই আগের যুগের বীণা ও বাদ্যযন্ত্র নেই। এ নতুন যুগের চারণকবিরা খুব সুন্দর সব পোষাক পরে এবং হাতে সুদর্শন ছড়ি ধরে ইলিয়াড ও অডিসি পড়ছেন শ্রোতাদের সমাবেশে। সক্রেটিস ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়লেন নতুন যুগের এই চারণকবিদের দেখে। তিনি বললেন: ‘তোমরা যারা গীতিকবি, তাদের পেশাটা দেখে আমার প্রায়ই হিংসা হয়। তোমাদের শিল্পচর্চার দাবি মেটানোর জন্য তোমরা কী সুন্দর সব কাপড় পরো, যতটা পারা যায় নিজেদেরকে সুন্দর করে উপস্থাপন করো, আর তোমরা অনেক চমৎকার সব কবির সৃষ্টি বিষয়ে কতো ভালোভাবেই না জানো, বিশেষ করে হোমারকে নিয়ে, হোমার—সবার থেকে সেরা এবং সবচেয়ে স্বর্গীয়।’২৩
হোমারের কবিতার এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য, এই অপার্থিব গীতিময়তা বিরাটভাবে মুগ্ধ করেছিল কবি এজরা পাউন্ডকে। একবার এক সঙ্গীতজ্ঞ পাউন্ডকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, কোথায় তিনি পেতে পারেন সবরকমের সব কবিতার সন্ধান, অর্থাৎ যেভাবে ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাখের সঙ্গীতের মধ্যে পাওয়া যায় সকল সঙ্গীতের খোঁজ? পাউন্ডের উত্তর ছিল, কেউ যদি সত্যি গ্রিক ভাষা শিখে ফেলেন তো সব কবিতার সন্ধান তিনি একসঙ্গে পেয়ে যাবেন, অথবা এক হোমারের মধ্যেই পেয়ে যাবেন মোটামুটি এর পুরোটাই।২৪
হোমারকে নিয়ে প্রশস্তিগাথা আসলে শেষ হবার নয়। এ বিষয়ে এক-দুটি প্রমাণ সাইজের বই লিখে ফেলা যায় শুধু আমার নিজের সংগ্রহে যে সমস্ত বইপুস্তক আর নিবন্ধ রয়েছে সেগুলোর সাহায্য নিয়েই। আমরা বরং শেষ করে আনি ‘ভূমিকা’-র এ অংশটি। এর শেষের জন্য টলস্টয়ের নিবন্ধটি নয় (যেটার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ দেওয়া আছে এ-বইতেই, যেখানে হোমারের প্রশংসা করতে গিয়ে টলস্টয় শেকস্পিয়ারকে শিল্প বা কাব্যের সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযোগহীন বলতেও ছাড়েননি), বরং সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা চোখ রাখি মহান কবি আলেকজান্ডার পোপের ১৭১৫ সালে লেখা ইলিয়াড-এর ‘ভূমিকা’-র অল্প কয়েকটি লাইনের দিকে:
‘বিশ্বজনীনভাবেই হোমারকে দেওয়া হয়েছে সকল লেখক-কবির মধ্যে মহত্তম সৃষ্টিটির স্রষ্টার স্বীকৃতি। বিচারকের প্রশস্তিগাথা পাবার জন্য ভার্জিল তার সঙ্গে ন্যায্যভাবেই প্রতিযোগিতা করেছেন, আর অন্যেরাও কোনো না কোনো বিশেষ উৎকর্ষের দাবিদার হয়ে আছেন বটে; কিন্তু হোমারের সৃষ্টি এখনও রয়ে গেছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। তাকে যদি কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হিসেবে কোনোদিন স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে তো তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ কবিতার যা কিছু ভিত্তিমূল সে সবে তিনিই সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ দেখিয়েছেন।...
‘আমাদের এই লেখকের কাজটি (ইলিয়াড) এক বন্য বেহেশত্। আমরা যদি এর সম্পূর্ণ সৌন্দর্যকে কোনো সাজানো বাগান দেখার মতো করে আলাদা আলাদাভাবে দেখতে ব্যর্থ হই, তবে তা কেবল এ-কারণেই যে এর (ইলিয়াড) সৌন্দর্যগুলির মোট সংখ্যা অগণনীয়রকমের বেশি।’

আগেই যেমন বলেছি, ক্লাসিক্যাল পৃথিবীর শুরুই হয় হোমারের হাত ধরে। প্রাচীনকালের গ্রিকদের সামনে কোনো পবিত্র আসমানি কিতাব ছিল না, যেমন বাইবেল বা কোরান। তাদের ছিল শুধু হোমার। হোমার শুধু তাদের সাহিত্যেরই স্রষ্টা নন, তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনেরও উৎসমুখ। গ্রিক মূল ভূখ- ও দ্বীপগুলি থেকে আসা কবি ও বিজ্ঞানীরা; আথেন্সের ট্র্যাজেডি ও কমেডি নাটকের নাট্যকারেরা এবং ফুলদানির চিত্রশিল্পীরা; সিসিলির বাগ্মীপুরুষ ও মন্দির-নির্মাতারা; সব শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও দর্শনের নানা ধারা ও উপধারার দার্শনিকেরা—এই নানা পেশার, নানা-চরিত্রের নানান মানুষেরা সবাই দেখা যেত স্রেফ একটি বিষয়েরই স্বচ্ছ জ্ঞান রাখে: হোমার। প্রকৃত অর্থেই সে যুগে ভূমধ্যসাগরের সবদিক বেড় দিয়ে—পশ্চিমে মার্সেই থেকে উত্তর-আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত আর পুবে কৃষ্ণ সাগর, এই বিস্তৃত এলাকার ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন সব সংস্কৃতি আর ভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গাটাতে—হোমারই ছিলেন একমাত্র আঠা, তিনিই ধরে রেখেছিলেন এর পুরোটাকে, যাকে আমরা আজ প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা নামে জানি। খ্রিস্টের জন্মের পরে, প্রথম শতকে, রোমান ইতিহাসবিদ কুইন্টিলিয়ান (Quintilian) হোমারকে তুলনা করলেন ওশেনাস নদীর সঙ্গে (যে ওশেনাসের কথা আমরা পড়ব ইলিয়াড-এ), যে নদী প্রাচীনকালের মানুষদের বিশ্বাস করা সমতল ও ডিস্ক-সদৃশ এক পৃথিবীকে বেড় দিয়ে রেখেছে এর সবপাশে। সবকিছুই তখন হোমার থেকে প্রবাহিত হতো, আবার হোমারেই ফিরে যেত। এই একই কথা, রূপক অর্থে, আমাদের আজকের পৃথিবীর সংস্কৃতি-সমাজ-রাজনীতির জন্যও প্রযোজ্য।২৫

হোমার ও তার কীর্তি: সারসংক্ষেপ

যে সমস্ত পাঠকের এত দীর্ঘ ভূমিকা পড়ার মতো সময় ও ধৈর্য নেই, তাদের জন্য এ-অংশে থাকছে হোমার ও তার সৃষ্টি বিষয়ক এই ভূমিকাটির সংক্ষিপ্ত এক রূপ। অন্য সব পাঠকের জন্যও মূল ‘ভূমিকা’র বিশদ অংশগুলোয় প্রবেশের আগে এই অংশটি সারসংক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।
হোমার (Homeros) প্রাচীন গ্রিসের দুই সর্বপ্রাচীন মহাকাব্যের কথিত স্রষ্টা—ইলিয়াড ও অডিসি। গ্রিকরা নিজেরাও চিরকালই সন্দিহান ছিল যে হোমার নামের কেউ আদতেই ছিলেন কিনা এবং থাকলেও তিনি কোন্ সময়কালের, তা নিয়ে। এই সব সন্দেহের সাগর পেরিয়ে এখন বরং সাধারণভাবে এটাই বিশ্বাস করা হয় যে, যদি হোমার নামে বাস্তবে কেউ থেকেও থাকেন, তবু তিনি আমাদের হাতে আছে যে ইলিয়াড ও অডিসি, সে দুটোর সাজানো-গোছানো এবং সম্পাদনার চেয়ে বেশি কাজ বোধহয় করেননি।
১৯৩০ সালে আমেরিকান গবেষক মিলম্যান প্যারি ও আলবার্ট বি লর্ড বলকান অঞ্চলের চারণকবিদের কাব্যের প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে আমাদের জানালেন যে, হোমারের কাব্যগুলি বাচনিক কবিতারই (oral poetry) ঐতিহ্য ধারণ করে আছে, যে ঐতিহ্য অনুযায়ী চারণকবিরা বা সুরকাররা (rhapsodes) দীর্ঘ কাব্যের সুদীর্ঘ সব অংশ মুখস্থ করে রাখতেন এবং স্মৃতি থেকে তা পাঠ করতেন জড়ো হওয়া বিরাট শ্রোতৃম-লীর সামনে কিংবা রাজা ও গোত্রপতিদের দরবারে। এই যুগান্তকারী তত্ত্ব মেনে নিলে এটাও মানতে হয় যে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১১০০ সালের মধ্যে সংঘটিত ট্রোজান যুদ্ধ বিষয়ক এক কাব্য মানুষের মুখে মুখে, বংশ থেকে বংশ পরম্পরায় এমনিতেই জারি ছিল, যা পরে হয়তো হোমার নামের অত্যন্ত মেধাবী ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা-চিন্তায় সমৃদ্ধ একজন মানুষ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে সপ্তম শতকের কোনো এক সময়ে সার্বিক সংগ্রহ, সম্পাদনা ও পুনর্গঠনের কাজটি করেন। আমাদের ইলিয়াড ও অডিসির, যদি ব্যাপারটা মিলম্যান প্যারির তত্ত্ব মোতাবেক ঘটে থাকে, আদিতম কিছুটা গোছানো রূপ হয়তো ওটাই ছিল। সে অর্থে হোমার নামের সেই লোকই যে এর স্রষ্টা তা পরোক্ষভাবে দাবি করাই যায়। চার-পাঁচশ বছর ধরে নানা অঞ্চলের নানা চারণকবির মুখে মুখে যে মহাকাব্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা রূপে টিকে ছিল, তার গোছানোর ও সম্পাদনার কাজটা, লিখন-প্রচলনের আগের সেই যুগে, নিঃসন্দেহে বিরাট-বিশাল এক কাজ ছিল বৈকি।
হোমেরিক কাব্যের কোনো কোনো অংশ একটা আরেকটার চেয়ে আগের বলে ধরা হয়—যেমন আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, ইলিয়াড সৃষ্টি হয়েছিল আগে আর অডিসি পরে, কারণ অডিসির ভেতরে ইলিয়াড-এ ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার রেফারেন্স আছে, কিন্তু এর উল্টোটা সত্য নয়। গবেষকদের অভিমত, এই ইলিয়াড-এর কোনো কোনো অংশ আবার তথাকথিত ট্রোজান যুদ্ধেরও আগের সৃষ্টি (১১৮৪ খ্রিস্টপূর্ব সনকে ধরা হয় ট্রোজান যুদ্ধের বছর হিসেবে, কিন্তু প্রতœতাত্ত্বিকেরা এখন আবার দাবি করছেন যে ট্রোজান যুদ্ধ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ১২২০ সনে)। এরই উল্টো দিকে, গবেষকেরা এটাও মনে করেন যে এই ইলিয়াড-এর (এবং অডিসিরও) কোনো কোনো অংশ আবার অনেক পরের (আগের অংশগুলির তুলনায় প্রায় পাঁচশ বছর পরের) সৃষ্টি। হোমার এই কালিক বিচারে আগের ও পরের, নানা কালপর্বের, মুখে মুখে নির্মিত দুই দীর্ঘ কবিতার নানা অংশকে একত্রে গাথলেন খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সনের কাছাকাছি গিয়ে। এখন যা কিছু আমরা হোমারের সৃষ্টি বলে জানি, তার সবই গ্রিক ভাষার আয়োনিক (Ionic) ডায়ালেক্টের (dialect; ভাষার আঞ্চলিক রূপ) এক প্রাচীন রূপ দিয়ে গড়া। এখন যা পশ্চিম তুরস্ক, সে অঞ্চলেই চল ছিল গ্রিক ভাষার এই আয়োনিক আঞ্চলিক রূপের। সে কারণে গবেষকদের অভিমত, হোমার গ্রিসের মূল ভূখ-ের লোক নন, তিনি এশিয়া মাইনরের (তুরস্ক ছিল যার অংশ) কেউ ছিলেন।
গ্রিসের সাতটি শহর—মূল ভূখন্ডের এবং একই সঙ্গে ঈজিয়ান সাগরের কিছু দ্বীপ—হোমারের জন্মস্থানের দাবিদার। প্রথাগত বিশ্বাস এটাই যে, হোমার অন্ধ ছিলেন। এই ধারণার পেছনে আছে তথাকথিত ‘হোমেরিক স্তোত্রগীত’ (Homeric Hymns)-এর একটি অংশ। জেনে রাখা ভালো, ‘হোমেরিক স্তোত্রগীত’ তেত্রিশটি কবিতার এক সংকলন যেখানে এক অন্ধ কবি বন্দনা জানাচ্ছেন গ্রিক দেবদেবীদের উদ্দেশে। একথা সত্যি যে, সে যুগের অনেক চারণকবি ও গীতিকার বাস্তবেই অন্ধ ছিলেন। অন্ধ মানুষদের হয়তো পেশাই ছিল বীণা বাজাতে বাজাতে গান শুনিয়ে ভিক্ষা করা, আর তাদের সে গানই ছিল আমাদের আজকের এই ইলিয়াড বা অডিসি।
ইলিয়াড ও অডিসি মহাকাব্যদুটো যার যার মতো করে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তারা দুটো মিলে আবার একসঙ্গে একটা ইউনিটের মতো। তারপরও বিষয়বস্তু ও টোনের দিক থেকে এ দুই মহাকাব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন চারিত্রের। ইলিয়াড-এর বিষয়বস্তু ট্রোজান যুদ্ধ নয়, বরং এটা ট্রোজান যুদ্ধের শেষদিকের মাত্র পঞ্চাশ দিনের এক কাহিনী, যা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি তার আগের দশ বছরে ঘটে যাওয়া ট্রোজান যুদ্ধের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন কখনও কখনও। ট্রোজান যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল আনুমানিক ১১৮৪ খ্রিস্টপূর্ব সালে, আর—আগেই যেমন বলেছি—ইলিয়াড একত্রে গাথা হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ বা ৬০০ সালের দিকে। ট্রোজান যুদ্ধের দুটি পক্ষ ছিল: একদিকে গ্রিকরা, অন্যদিকে ট্রোজানবাহিনী ও তাদের মিত্রেরা, আর এর ঘটনাস্থল ছিল ট্রোয়াড অঞ্চল (ট্রয় শহরের আশেপাশের অঞ্চলকে বলা হয় ট্রোয়াড; অবস্থান তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমে, আনাতোলিয়ায়)। প্রসঙ্গত ট্রয়ের অধিবাসীদেরকে বলা হতো ট্রোজান। গ্রিক-ট্রোজান এই দশ বছরব্যাপী যুদ্ধের পেছনের পোশাকি কারণ ছিল ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিস কর্তৃক গ্রিসের স্পার্টার রানি হেলেনের অপহরণ। হেলেন ছিল স্পার্টার রাজা মেনেলাসের স্ত্রী, আর মেনেলাস ছিল মাইসিনির রাজা আগামেমননের ছোট ভাই। রানির অপহরণে অপমানিত, ক্ষুব্ধ গ্রিকরা তাদের এই রানিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এবং ট্রোজানদের এই ঘৃণ্য কাজের উচিত শিক্ষাটি দিতে প্রায় বারোশত জাহাজ নিয়ে জড়ো হলো ট্রয়ের উপকূলে, ট্রয় নগর গুঁড়িয়ে দেবার উচ্চাকাঙ্খা বুকে পুষে। প্রতিশোধপরায়ণ এই বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ আগামেমনন, আর অ্যাকিলিস তাদের সেরা যোদ্ধা।
ইলিয়াড-এর কাহিনী গ্রিক বনাম ট্রোজানবাহিনীর মধ্যেকার সংগ্রামের চাইতে অনেক বেশি গ্রিক বীর অ্যাকিলিসের দুই পর্বের দুই ক্রোধ দিয়ে গড়া: প্রথমে সে ক্রোধান্বিত তারই রাজা আগামেমননের প্রতি, আর পরে সে ক্রোধে ফুঁসছে সেরা ট্রোজান যোদ্ধা হেক্টরের ওপরে, কারণ হেক্টর তার প্রিয়তম বন্ধু প্যাট্রোক্লাসকে খুন করেছে। ট্রোজান যুদ্ধকে পশ্চাৎপটে রেখে ইলিয়াড তাই যতটা না জাতিতে জাতিতে এক যুদ্ধের গাথা, তার চেয়ে বেশি এর কয়েকটি প্রধান চরিত্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিবরণ। আর যদিও যুদ্ধ এ মহাকাব্যের সবথেকে বেশি অংশ জুড়ে আছে, তবু এতে যুদ্ধের রক্তপাত ও নৃশংসতার বাইরে গিয়ে রয়েছে নিজস্ব এক উচ্চাঙ্গের টোন, এক অভিজাত, পরিশীলিত, মার্জিত চেহারা, যা সাক্ষ্য দেয় গ্রিক সভ্যতার ক্লাসিক্যাল যুগ পূর্ববর্তী ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের রুচি-পছন্দেরই। এ মহাকাব্যের ইতি ঘটে অ্যাকিলিসের হাতে ট্রোজান হেক্টরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আমরা দেখি অ্যাকিলিস হেক্টরের মরদেহ পুরো ট্রোজান জাতির সামনে দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে গ্রিক শিবিরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যে মরদেহ শেষে সে ফেরত দেবে হেক্টরের পিতা প্রায়ামের কাছে। ইলিয়াডেই আমরা জানতে পারি যে, অল্প কদিনের মধ্যেই অ্যাকিলিসেরও মৃত্যু ঘটবে, ট্রয় নগরের পতন হবে ইত্যাদি, কিন্তু ইলিয়াড-এ সেসবের কিছুই নেই, নেই বিখ্যাত ‘ট্রোজান ঘোড়া’র প্রসঙ্গও। ইলিয়াড সে-সবকিছুর পূর্বসংকেত রেখে শেষ হয় হেক্টরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিবরণ রেখে।
ইলিয়াড-এর ঘটনা পরম্পরা কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার নিখুঁত বিবরণ নয় নিশ্চয়ই। গবেষকদের অভিমত, ট্রোজান যুদ্ধের মতো কোনো যুদ্ধ আসলেই সংঘটিত হয়েছিল একদিন; কিন্তু হেলেন নামের এক নারী তার পেছনের কারণ ছিল কি না, বা সেই যুদ্ধটি দুই ভিন্ন জাতির লোকদের মধ্যে (গ্রিকরা বনাম এশিয়া মাইনরের ট্রোজানরা) ঘটেছিল কি-না, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছেন না। ইতিহাসবেত্তাদের অবশ্য বিশ্বাস, এ-যুদ্ধ দুই ভিন্ন জাতির মধ্যে ঘটেনি, ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে প্রথমদিককার গ্রিকদের (যাদের আমরা মাইসিনিয়ান গ্রিক নামে চিনি) দুই দলের মধ্যে; আর সে যুদ্ধের কারণ ছিল কোনো নারী নয়, বরং কৃষ্ণ সাগর অভিমুখে প্রবাহিত সংকীর্ণ পানিপথের (যার নাম হেলেস্পন্ট) নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব লাভের বিষয়টা। ইতিহাসবেত্তাদের এসব অভিমতের পেছনেও জোরালো কোনো ঐতিহাসিক বা প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ যে রয়েছে, তেমন নয়। এই ইতিহাসবেত্তারাই বর্তমানে চালু ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত ও পোক্ত করেছেন যে, ট্রোজান যুদ্ধ যতটা না ছিল এক নারীর অপহরণ বিষয়ক আপাত হাস্যকর এক কারণের ওপর দাঁড়ানো কোনো ঘটনা, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ঐ অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তার ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রিকদের রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার প্রকাশ।
অন্য মহাকাব্য অডিসি-র প্রসঙ্গে বলতে হয়, কবি এই বাচনিক কবিতাটি (ড়ৎধষ ঢ়ড়বস) জড়ো করে একত্রে গাঁথেন ইলিয়াড গাঁথা হয়ে যাওয়ার অনেক পরে। এই অনুমানের পেছনে দুটি শক্ত কারণ আছে: এক. আগেই যেমন বলেছি, অডিসি-তে রয়েছে ইলিয়াডের নানা ঘটনার উল্লেখ, আর এতে বলাই আছে যে, এখানে ইলিয়াড-এর অন্যতম নায়ক অডিসিয়ুস বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ট্রোজান যুদ্ধের শেষে; দুই. অডিসিতে কবির ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল সম্বন্ধে অনেক বেশি জানাশোনা স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। গ্রিকদের এ-অঞ্চল সম্বন্ধে এতটা প্রগাঢ় জ্ঞান লাভ হয় খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে গ্রিকরা ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে নানা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা এবং দ্বীপ ও রাজ্যগুলির সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের পরেই। অন্য কথায়, অডিসি-তে এ অঞ্চল বিষয়ক যে বিশদ জ্ঞানের দেখা মেলে, তা অষ্টম শতকে গ্রিক সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটার আগে কারও পক্ষে লাভ করা সম্ভব ছিল না। অতএব মানুষের মুখে মুখে ইলিয়াড সৃষ্টি হতে থাকার শুরু যেখানে খ্রিস্টপূর্ব বারোশত সালের দিকে, সেখানে অডিসিরটা অষ্টম শতকের কিছু আগে পরে।
অডিসি ট্রোজানযুদ্ধ শেষে গ্রিক বীর অডিসিয়ুসের ট্রয় থেকে বাড়ি ইথাকায় ফেরার এক দশ বছরব্যাপী দীর্ঘ সংগ্রামের অ্যাডভেঞ্চারমূলক উপাখ্যান। সমুদ্রপথে তার এই দশ বছরের বিপদসংকুল সফর তাকে নিয়ে যায় দূর পশ্চিমের হেসপিরিদেস (সম্ভবত এখনকার জিব্রাল্টার) থেকে শুরু করে এমনকি মৃত্যুর পরের জগতেও, যেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় অনেক মৃত বন্ধুর আত্মার, যেমন অ্যাকিলিসের। শেষমেশ অডিসিয়ুস ঘরে ফেরে, তার ঘর গ্রিসের পশ্চিম উপকূলের ইথাকা; এবং সে তার অবর্তমানে তার স্ত্রী পেনেলোপিকে বিশ বছর ধরে উত্যক্ত করতে থাকা প্রেমপ্রত্যাশীদেরকে একে একে হত্যা করে স্ত্রী পেনেলোপি ও পুত্র টেলেমেকাসের সঙ্গে একত্রিত হয়।
ইলিয়াড একটি ট্র্যাজেডি (বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ট্র্যাজেডি) আর অডিসি—তার সুখে ভরা সমাপ্তির মধ্য দিয়ে—এক অ্যাডভেঞ্চার গাথাভিত্তিক বা রূপকথাসুলভ কমেডি। গ্রিকরা এই ইলিয়াড ও অডিসি-র পাশাপাশি আরও কিছু কাজকে দাবি করেছেন হোমার বা হোমেরিদে-র (Homeridae—হোমার সম্প্রদায়; আক্ষরিক অর্থে ‘হোমারের পুত্রেরা’) সৃষ্টি হিসেবে। এর মধ্যে আছে ‘ট্রোজান মহাকাব্য চক্র’ (Trojan Epic Cycle) যা গঠিত মোট আটটি (মতান্তরে বারোটি) মহাকাব্য নিয়ে। এই আটটিরই দুটি হচ্ছে টিকে থাকা এপিক—ইলিয়াড ও অডিসি; যেখানে অন্য ছয়টি টিকে আছে ¯্র্েরফ সামান্য কিছু খ-াংশের ওপর ভিত্তি করে। ওই ছয়টির বিষয়বস্তু ইলিয়াড-এর আগের ও পরের ট্রোজান যুদ্ধের নানা কাহিনী, নানা ঘটনা, যেগুলি ইলিয়াড-এ স্থান পায়নি। হোমারের সৃষ্টি হিসেবে আরও ধরা হয় Homeric Hymns-কে (হোমারের স্তোত্রগীতি) যার কথা আগেই বলেছি, এবং সেইসঙ্গে তিনটি প্যারোডিকে: ‘The Margites’; ‘The Cercopes’ (অর্থাৎ Monkey-Man বা বাঁদর-মানুষ); এবং ‘The Batrachomyomachia’ (Battle of the Frogs & Mice; ব্যাঙ ও ইদুঁরের যুদ্ধ)। এই তিন প্যারোডির প্রথম দুটির স্রেফ সংক্ষিপ্ত কিছু খ- টিকে আছে। এ সবকিছুই, হোমারবিদদের অভিমত, হোমার ইলিয়াড ও অডিসি-কে তাদের বর্তমান রূপ দেবার অনেক পরের কাজ। এগুলির সৃষ্টির কাল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে সপ্তম থেকে পঞ্চম খ্রিস্টপূর্ব শতককে, অর্থাৎ এ দুইশ বছরের মাঝের কোনো এক কালকে।
একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, হোমারের কাব্যগুলি, তাদের অন্তর্গত অভিঘাত ও অবস্থানের দিক থেকে, গ্রিকদের কাছে ছিল বাইবেল বা কোরানের মতো। এই কাব্যগুলিতেই তারা খোদা বা ঈশ্বর বলে যা কিছুকে বিশ্বাস করতো তার সবকিছুর সম্মিলন আছে। বাইবেলের খোদা বা নবীদের মতোই অবস্থানে রয়েছে এই মহাকাব্য দুটির জিউস, হেরা, অ্যাথিনা, অ্যাপোলো, হারমিস ও অন্যেরা, যারা বাস করতো উত্তরপূর্ব গ্রিসের অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায়। ইলিয়াড ও অডিসির এভাবে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় ধর্মগ্রন্থের স্থান নিয়ে দেবার দিকটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এ অর্থে, ইলিয়াড নামের রাজনৈতিক উপাখ্যানটির এক ধর্মতাত্ত্বিক দিকও আছে, যেমন আছে অডিসি নামের অ্যাডভেঞ্চারটির।
হোমার পরবর্তীকালের গ্রিক এবং অন্যান্য ইউরোপীয় সাহিত্য ও শিল্পকলায় বিরাট প্রভাব রাখেন। গ্রিক ও রোমান সাহিত্যিকেরা হোমারের ইলিয়াড ও অডিসিকে যে কী বিশাল সম্মানের আসনে রেখেছিলেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাদের কেউই, একবারের জন্যও, অ্যাকিলিস-হেক্টর-অডিসিয়ুসের এই কাহিনীদুটোর কোনো পুনর্গঠন বা পুনর্লিখন করেননি, যদিও আমরা তাদেরকে হরহামেশা দেখেছি বাকি সব গ্রিক বীর ও দেবদেবীর কাহিনীগুলো নিয়ে কবিতা, নাটক বা ইতিহাসের বই লিখতে। ইলিয়াড ও অডিসির সম্মান ও অবস্থান পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর মতো এক উচ্চাসনে ছিল বলেই এ দুটোতে কখনোই হাত দেননি তারা।
খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬-৭০০ সালের দিকে (বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের মতে হোমারের জন্মসাল খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০) গ্রিসে প্রথম চালু হয় লিখনের। এর আগে (খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ সালের দিকে) ছিল মাইসিনিয়ান হস্তলিপি, যার নাম Linear B, কিন্তু তা ঠিক ‘লিখন’ (বা writing)-এ ব্যবহৃত হতো কি না এবং মাধ্যম হিসেবে লিখনের বিস্তার তখন কতটা ছিল সেসব নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিরাট দ্বিমত রয়েছে। যা হোক, ৭৭৬-৭০০ সালের দিকে ফিনিশিয়ান বর্ণমালার এক আদি রূপ আসে, এবং গবেষকদের বিশ্বাস যে এ সময়েই শুরু হয়ে যায় হোমারের এই স্মৃতিনির্ভর মহাকাব্যদুটির প্যাপিরাস কাগজে লিখে ফেলা। পরে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের দিকে আলেকজান্দ্রিয়ান টেক্সটে (Alexandrian Vulgate) লিখে ফেলা হলো এ দুই মহাকাব্য। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারিকেরা অনেক গবেষণা ও যাচাই-বাছাইয়ের পরে দাঁড় করালেন এ দুই মহাকাব্যের নতুন দুটি রূপ যেগুলি আমাদের হাতে থাকা বর্তমান ইলিয়াড ও অডিসি-র খুবই কাছাকাছি কিছু। ঠিক এ-সময়েই এ দুই মহাকাব্য বিন্যস্ত হলো চব্বিশটি করে পর্বে, পর্বগুলির শিরোনাম হিসেবে দেওয়া হলো গ্রিক বর্ণমালার এক একটি করে বর্ণ। জেনোডোটাস, আরিস্তোফানেস ও অ্যারিস্টারকাস নামের তিন আলেকজান্দ্রিয়ান হোমারবিদ শুধু যে মহাকাব্যদুটোর আধুনিক রূপটা দিলেন এবং মিশরের প্যাপিরাসে তাদেরকে লিপিবদ্ধ করলেন, তা-ই নয়; সেইসঙ্গে তারা তাদের পৃষ্ঠাগুলোর মার্জিনে লিখে রাখলেন অমূল্য সব টীকা, ভাষ্য, ব্যাখ্যা, বিবৃতি, যাদেরকে সম্মিলিতভাবে বলা হয় scholia (স্কলাইয়া)। এসব স্কলাইয়ার মধ্যে অ্যারিস্টারকাসের লেখা স্কলাইয়াগুলির বড় অংশ আজও টিকে আছে। অ্যারিস্টারকাস আরও একটি বড় কাজ করেন: তিনি দু মহাকাব্য থেকেই বেশ কিছু পঙ্ক্তি ঝেড়ে ফেলে দেন সেগুলো হোমার-উত্তর কালের চারণকবি বা রাজকবিদের যার যার স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংযোজন ছিল, এই সিদ্ধান্তে এসে। এ-সময় থেকেই (খ্রিস্টপূর্ব ২২০ থেকে ১৫০ সাল) ইলিয়াড-এর লাইন সংখ্যা ১৫,৬৯৩ এবং অডিসি-র ১২,১০৬।
অ্যারিস্টারকাসের এই বিশাল কাজটির প্রায় বারো শ বছর পরে (৯৫০ খ্রিস্টাব্দে) তৈরি হলো ইলিয়াড-এর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাচীন পা-ুলিপি ভেনেটাস-এ (Venetus A)। অ্যারিস্টারকাস ও আলেকজান্দ্রিয়ার গবেষকদের স্কলাইয়াগুলি, আগেই যেমন বলেছি, পুরোপুরি আমাদের হস্তগত হয়নি কোনোদিন। এদের বদলে আমাদের হাতে ভেনেটাস-এ-ই আছে প্রাচীনতম পা-ুলিপি হিসেবে। ১৭৮৮ সালে ফরাসি গবেষক ভিলোইসঁ প্রথমবারের মতো লোকচক্ষুর অন্তরালের এই ভেনেটাস-এ পা-ুলিপি প্রকাশ করলেন, আর সেইসঙ্গে শুরু হয়ে গেল আধুনিক হোমার-গবেষণার যুগ।
এর মাত্র সাত বছরের মাথায় জার্মান প-িত ফ্রেডেরিখ অগাস্ট উলফ্ লিখলেন তার চৎড়ষবমড়সবহধ ধফ ঐড়সবৎঁস (‘হোমারে প্রবেশিকা’) এবং আধুনিক যুগে প্রথমবারের মতো উসকে দিলেন হোমেরিক কোশ্চেনগুলি: কে হোমার? মানুষের মুখে মুখে, স্মৃতির ওপর ভর করে টিকে থাকা এ দুই দীর্ঘ মহাকাব্যের লিখিত টেক্সট কতোটা মূলানুগ আর কতোটা শিক্ষিত মানুষদের রুচিবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত? আদি হোমারের আদি মহাকাব্যদুটি কি ভেনেটাস-এ পা-ুলিপির সঙ্গে মেলে বা মিলতে পারে, যেখানে প্রথমটার স্রষ্টা ভিক্ষা করে বেড়ানো চারণকবিরা, আর দ্বিতীয়টার আলেকজান্দ্রিয়ান শিক্ষিত গবেষকেরা? উলফ্-এর গবেষণা-উদ্ভূত এই বিতর্ক থেকেই জন্ম হলো দুই ভিন্নধারার হোমারবিদদের: একদিকে অ্যানালিস্টরা (Analyst) যারা বলেন, এ দুই মহাকাব্য কোনো একক মানুষের কাজ নয়, হোমার নামের মানুষটি স্রেফ মিথ বা চারণকবিতার ঐতিহ্যেরই প্রতীকী এক নাম; অন্যদিকে ইউনিটারিয়ানরা (Unitarian) যাদের মতে এ-দুই মহাকাব্য দীর্ঘ শতাব্দীর বাচনিক গাথার কংকালের ওপর দাঁড়ানো অবশ্যই, কিন্তু সেই কংকালদুটোকে একজন মানুষের একটা মাথাই এর বর্তমান রূপটি দিয়েছে, অর্থাৎ এ মহাকাব্যদুটোর ভেতরকার সংহতি, রেফারেন্স, ক্রস-রেফারেন্স, শব্দচয়ন, প্রকরণশৈলী এতোখানিই একত্র আসঞ্জনশীল (coherent) যে এরা একের অধিক কবির সৃষ্টি, এমনটা হওয়া সম্ভবই নয়।
উলফের বিতর্কের পঁচাত্তর বছর পরে, ১৮৭০ সালে, ধনাঢ্য জার্মান ব্যবসায়ী হেইনরিখ শ্লিয়েমান আধুনিক তুরস্কের ঈজিয়ান সাগর উপকূলের হিসারলিকে ‘ট্রয় প্রোজেক্ট’ নামের বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করলেন। তার বারো বছর খননের পরে বিশ্ববাসী সাক্ষাৎ পেল অনেকগুলি ট্রয় নগরীর এবং রাজা প্রায়ামের অনেক সম্পদের। তবে শ্লিয়েমানের খননের এই উপসংহার নিয়ে বিতর্ক আজও আছে।
মধ্যযুগে যখন ছাপাখানার উদ্ভাবন হলো তখন হোমারের মহাকাব্যদুটিই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে একেবারে প্রথমদিককার ছাপা হওয়া কয়েকটি বইয়ের অন্যতম। ১৪৮৮ সালে ইতালিতে, গ্রিকভাষায়, প্রথম বের হলো ছাপার অক্ষরে হোমার। আর ১৯০২ সালে এসে, আরও আধুনিক গবেষণা উপাদানের সুযোগ সুবিধা নিয়ে, প্রতিষ্ঠিত হলো ইলিয়াড ও অডিসি-র চূড়ান্ততম গ্রিক পা-ুলিপি, যার নাম হয়ে গেল ‘অক্সফোর্ড ক্লাসিক্যাল টেক্সট’। ডি. বি. মনরো ও টি. ডব্লু. অ্যালেনের দাঁড় করানো এই টেক্সটটিই অধিকাংশ ইংরেজি অনুবাদের মতো আমাদের হাতের এই বাংলা অনুবাদেরও ভিত্তি।
বিংশ শতাব্দীতেই, ‘অক্সফোর্ড ক্লাসিক্যাল গ্রিক টেক্সট’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি, ঘটল হোমার গবেষণায় আরেকটি বড় ঘটনা। ১৯৩৩-১৯৩৫ সালে আমেরিকান গবেষক মিলম্যান প্যারি ও অ্যালবার্ট বি. লর্ড অধুনালুপ্ত যুগোশ্লাভিয়ার চারণকবিদের ওপরে গবেষণার পরে জানালেন যে, হোমারের কবিতা চারিত্রে মৌখিক বা বাচনিক কবিতা (oral poetry), এবং সেইসঙ্গে চারণকবিরা কীভাবে তাদের স্মৃতির ভা-ারে থাকা ফরমুলা বা গৎবাঁধা শব্দ, বাক্যাংশ, বাক্য নিয়ে এসব কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন তা-ও দেখালেন এরা দুজন।
১৫৯৮ সালে জর্জ চ্যাপম্যান প্রথম ইংরেজিতে ইলিয়াড অনুবাদ করার পরে আজ পর্যন্ত এর প্রায় ৩১৫টি অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। হোমারের দুটি মহাকাব্যেরই কাব্যানুবাদ করেছেন দার্শনিক টমাস হবস্ থেকে নিয়ে আলেকজান্ডার পোপ, এ. টি. মারে থেকে বর্তমানকালের রবার্ট ফ্যাগলস্ পর্যন্ত অনেকেই। আর এর গদ্য অনুবাদও হয়েছে বেশ কটা, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ল্যাঙ-লিফ-মায়ার্স (Andrew Lang, Walter Leaf, Ernest Myers), স্যামুয়েল বাটলার ও ই. ভি. রিউয়েরটি। মূলের প্রতি বিশ্বস্ততার নিরিখে আজ পর্যন্ত তালিকার সবচেয়ে উপরে আছে তিন ইংরেজি অনুবাদ, তিনটিই কাব্যে: এ. টি. মারে, রিচমন্ড ল্যাটিমোর ও অ্যান্থনি ভেরিটি। ‘অক্সফোর্ড ক্লাসিক্যাল গ্রিক টেক্সট’-এর পাশাপাশি এ তিনটি আক্ষরিক অনুবাদকেই অনুসরণ করা হয়েছে ইলিয়াড-এর এই বাংলা অনুবাদে।

চলবে...